উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: সতর্কতা ও পরামর্শ
উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সময়ে গণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াই দূর্বলতা থাকলে ভঙ্গুর অর্থনীতি আমাদের সামনে চলে আসবে। এটা মাথায় রেখে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখনি প্রয়োজন।
ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তা চেয়ে বলেছেন: এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ করে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য এডিবির সহায়তা কামনা করেন। এদেশের গ্রামীণ ও নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে এডিবির সহায়তা রয়েছে। বাংলাদেশ কভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে। সরকার এখন দেশের গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে সুন্দর উন্নত জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে জমিসহ বাড়ি দিচ্ছে। এদিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ৫ হাজার ৮২৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১১টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। বৃহত্তর যশোরবাসীর শিক্ষা ও প্রায়োগিক গবেষণার উন্নয়নে সরকার ‘শেখ জহুরুল হক পল্লি উন্নয়ন একাডেমি, যশোর’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নি:সন্দেহে এটি সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রকল্পটি যথাযথ ভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আধুনিক গবেষণা ও কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে বলে আশা করা যায়।
সরকারকে শুধু আয় বাড়ানোর দিকে নয়, ব্যয় নির্ধারণের বিষয়ে সম্পূর্ণ সতর্ক থেকে কাজ করতে হবে, না হলে শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মতো বিপদ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে। প্রকল্প অর্থায়নের নামে বড় বড় প্রকল্পগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রকল্পের সময় ও আকার বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যয় নির্ধারণ যেন বেশি না হয়ে যায়। সম্পদের সুষম বন্টন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকলে জাতীয় উন্নয়ন সঠিক ভাবে হবে না। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৪৩২ ডলার বা ৩৭ হাজার ৫৮৪ টাকা। যা আমাদের অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ ফেলবে। একারণে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করতে হলে নিজের সক্ষমতার ভিত্তিতে শতভাগ সিদ্ধান্ত যেন হয়। আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন- যা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম বাজেট। মহামারী পরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। এতে প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন ধরা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট যার ৬৪ শতাংশ অর্থই থাকবে পরিচালন ব্যয় বাবদ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ১২ শতাংশ বাড়িয়ে এনবিআর-কে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে ঘাটতি থেকে যাবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
প্রতিবারের মতো এবারও আসন্ন বাজেটে প্রাধান্য পেতে পারে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত। আগামী বাজেটে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হবে। বিশেষ করে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দিতে দেশের আরও ১০০ উপজেলায় নাম চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এই ভাতা কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সুসংবাদ এবং আমাদের অগ্রযাত্রায় অংশীদার হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন ব্যবসায়ীরা। করোনা মহামারী থেকে অর্থনীতি পুণরুদ্ধার এবং বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট তৈরি করেছে। খাবারের দাম ইতিমধ্যে আকাশচুম্বী হয়েছে্। যুদ্ধের তাপে টানাপোড়নে বিশ্বঅর্থনীতি তার প্রভাবে অস্থির দেশের পণ্য বাজার। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে পুরোপুরি গতি ফিরে আসেনি দেশের পণ্য বাজারে। এরমধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। বিশ্বব্যাপী চরম সংকট মাথায় নিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে নজর সরকারের। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা এবং দেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দার পূর্বাভাস সত্বেও আসছে অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ায় আশঙ্কা তো রয়েছেই, সেই সাথে বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্য পণ্যসহ পণ্যবাজার অস্থির হবার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে উন্নয়ন ব্যয়সহ সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে। যুদ্ধ এবং করোনা দীর্ঘায়িত হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি-বাণিজ্য ও শ্রমবাজার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। অর্থনৈতিক পুর্নরুদ্ধার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সংকট কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ এবং দূরদর্শী নীতির ফল হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈষণীয়। ডিজিটাল নবজাগরণ ইতিমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই নবজাগরণে গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সামাজিক সংগঠন, প্রক্রিয়ার অভূতপূর্ব নারীর ক্ষমতায়ন চোখে পড়ার মতো। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং পল্লি উন্নয়ন সংস্থাগুলো পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করতে পেরেছে বাংলাদেশ- এটা গর্বের সাথে বলতে হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে উন্নয়ন ম্লান হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তিনি দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের জন্য সবাইকে একই পতাকাতলে ডাক দিয়েছিলেন। দুনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, কালোবাজারি, অর্থপাচার এ ধরণের অপরাধের বিরুদ্ধে জাতির পিতা সব সময় সোচ্চার ছিলেন।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন নাজুক হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ তখন উপযুক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবেলায় সক্ষমই শুধু হয়নি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশ বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। নগর ও গ্রামাগুলোর জীবনযাত্রায় মানের বৈষম্য হ্রাস করণের জন্য সরকার সুদূরপ্রসারী চিন্তার রূপরেখা একেছেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প অন্যান্য শিল্পের বিকাশ, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে এদেশে একটি টেকসই আর্থ-সামাজিক এককে পরিণত হতে পারে। বঙ্গবন্ধু অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যা আজকের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ লক্ষ্যমাত্রায় ঠাঁই পেয়েছে।
উন্নয়ন যেখানে হবে প্রতিবন্ধকতাও হানা দিবে পাশাপাশি। সুতরাং উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাকে কিভাবে দূর করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া যায় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শৃংখলা বজায় রাখা যায় সে বিষয়ে বিশেষভাবে পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছে বাংলাদেশ। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক