বাইক: অ্যাপে না খ্যাপে ?
কি বলে ডাকবেন তাদের? ‘এই বাইক যাইবা?’ রিকশাওলাকে এইভাবে ডাকি আমরা। সিএনজিচালকসহ অটোরিকশাকে ডাকি শুধু ‘সিএনজি’ বলে। কিন্তু যারা মোটরসাইকেল চালান তাদের বিশেষায়িত করার কোনো তকমা তৈরি হয়নি। বেশ অসুবিধাই হয়েছে।
মোড়ে মোড়ে ঝাঁক ধরে মোটর সাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ সুদর্শন আধুনিক তরুণরা মোটার সাইকেলের ওপর বসে থাকেন। তারা সবাই ভাড়ায় গাড়ি চালান। তার কোনো প্রতীকী রকমফের নেই। অগত্যা বলতে হবে, ভাই যাবেন নাকি? চেহারা দেখে মনে হয় না তারা ভাড়ায় গাড়ি চালান। সংশয় মনে নিয়ে এই প্রস্তাব জানাতে হয়। এ বড় অসুবিধার কথা।
ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মোটর সাইকেলে। প্রতিটি চালু সড়কের বামপাশের বিশাল জায়গা ওদের জন্য ছেড়ে দিতে হয়। কোথাও যানজট পড়লে সেখানে মুহূর্তে সগৌরব সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে মোটর সাইকেল। এই মোটর সাইকেলের প্রায় পুরোভাগই ভাড়ায় যাত্রী টানছে।
অগণিত মানুষ জীবন জীবিকার জন্য বাণিজ্যিক মোটর সাইকেল চালক হয়ে উঠেছেন। এখন আর উবার, পাঠাও, ওভাই জাতীয় কোনো কোম্পানির নিবন্ধন লাগে না। মোবাইল অ্যাপ, জিপিএস, যাত্রীসেবা, পেশাদারিত্ব, সুমিষ্ট ব্যবহার লাগে না। ধরা যাক আপনি মোটরসাইকেল নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, কোনো এক জায়গা থেকে কেউ আপনাকে ভাড়া করলো। আপনি অনায়াসে তাকে নিয়ে নামিয়ে দিলেন। তিনি ভাড়া চুকিয়ে দিলেন। এই সহজ ব্যাপারটা অসাধারণ সুবিধা এনে দিয়েছে। কিন্তু এই সুবিধার সঙ্গে নিরাপত্তা, চালকের পেশাদারিত্ব, নির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতির সংস্রব নেই।
করোনাকালের আগে ঢাকায় অ্যাপনির্ভর মোটর বাইকের এক সুশৃংখল যোগাযোগ সেবা বলয় গড়ে ওঠে। গাড়ির পাশাপাশি অনেকেই মোটর বাইকে নিশ্চিন্তে চলাচল করছিলেন। মোটর বাইকে বসে চালক যাত্রীর সঙ্গে সুমিষ্ট আচরণ করতেন। তার সার্ভিস ও আচরণের সঙ্গে একটি নাম্বার ও পুরস্কার যুক্ত ছিল। তার যেকোনো বাজে আচরণের জন্য অভিযোগ জানানোর সুযোগ ছিল। চালক ও যাত্রী দুজনেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর জিপিএস পর্যবেক্ষণের আওতায় চলে যেতেন। বহু স্বপ্নবাজ তরুণ এই ব্যবস্থায় নিজে বেশ ক্ষমতায়িত হয়েছিলেন। তারা নিজেদের কেনা মোটর বাইকটির যথাযথ লাইসেন্স কাগজপত্র ও নিজের সঠিক চালক সনদ নিয়ে তবেই উবার, পাঠাও বা অন্য যো কোনো কাম্পানীর তালিকাভূক্ত হতে পারতেন। নিজের কাজের ফাঁকে নিজের মোবাইলের অ্যাপ অন করে রাইডার হিসেবে কাজ শুরু করতেন।
করোনাকালে মানুষের চলাচল একেবারে সীমিত হয়ে পড়ায় ওদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। উপার্জন থেমে যায়। অনেক উবার, পাঠাও চালক এই কাজ বন্ধ করে অন্যদিকে সরে যান। অনেকে গ্রামে ফিরে যান। ঠিক এই সময় থেকেই শুরু হয় ছন্দপতন। করোনা শিথিল হওয়ার পর অসংখ্য মোটর বাইক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। বেকার তরুণ, স্বল্পায়ী কর্মজীবীরা নিজের মোটর সাইকেলটিকে উপার্জনের হাতিয়ার ভেবে পথে বেরিয়ে পড়েন। যেকোনো মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী ডেকে বহন করতে শুরু করেন। তাদের কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই, কাগজপত্রের হিসেব নেই, চালক সনদ আছে কি নেই, তারও খোঁজ খবরের ব্যাপার নেই। এখনও উবার পাঠাও নেই তা বলা যাবে না। তাদের দেখাদেখি যেসব ছোট ছোট অ্যাপ রাইডার কোম্পানি তৈরি হয়েছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। উবার পাঠাও গাড়িতে তাদের অ্যাপভিত্তিক কিছু ভাড়া পেলেও মোটর বাইকে যাত্রীসেবা ও উপার্জনের হিসেবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বলা যেতে পারে তাদের সুপরিকল্পিত আধুনিক ও আন্তর্জাতিকমাণের সার্ভিস কার্যক্রমে লালবাতি জ্বলছে।
তাতে কোনো অসুবিধা নেই। বাণিজ্য ঠিকই সম্প্রসারিত রয়েছে। রাস্তায় মোটর বাইকের কোনো অভাব নেই। রাস্তায় এখন রিকশা ও সিএনজির চেয়ে অনেক বেশি মোটর বাইক। রাস্তায় মোটর বাইকের ভীড়। অনেক দামী মোটর বাইকে শিক্ষিত সুদর্শন তরুণরা ভাড়া খাটছেন।স্বাধীন উপার্জন ব্যবস্থাটি তারা উপভোগ করছেন। কিন্তু ব্যবস্থাটি শৃংখলা হারিয়েছে।
রাস্তায় চেনার উপায় নেই কোন গাড়িটি ভাড়া খাটছে, আর কোনটি খাটছে না। এর জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি ও উদ্যোগ নেই। অন্তত. ভাড়া গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট রঙের হেলমেট ব্যবহার করার নির্দেশ থাকতে পারে। যদিও এখন প্রকাশ্য গোপনে ভাড়া খাটা গাড়িগুলো ধরার কোনো কায়দা নেই। তারা যদি ভাড়া যাত্রীর কথা মুখে স্বীকার না করেন তাহলে তা প্রমাণ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অনিয়মটি চালু থাকলেই বরং চালকদের জন্য সুবিধা।
অনিয়মটি দূর করতে দমন পীড়নের চেয়ে একটি সহজ রোজগারবান্ধব একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার। যা যে কোনো বাইক রাইডারকে উৎসাহিত করতে পারে।
কাগজপত্রের বৈধতা নেই এমন বাইক রাস্তা থেকে সরাতে হবে। আর অবশ্যই ট্রাফিক পুলিশ প্রশাসন অথবা রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটিকে দায়িত্ব নিয়ে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করতে হবে, যে অ্যাপটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকবে না। থাকবে বাইক চালক ও যাত্রীর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। যে কোনো মোটর বাইকে যে কেউ উঠবে। কবে ওঠার সময় দুজন পরস্পরের মোবাইলের অ্যাপ থেকে একটি কিউআর কোড স্ক্যান করবে। তাতেই দুজনের ঠিকানা বিনিময় হয়ে যাবে। একইভাবে প্রশাসনের কাছেও দুজনের তথ্য সংরক্ষিত হয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে দুজনই পরস্পরের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে।
এখন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক বাইক চলছে একেবারেই মোবাইল অ্যাপ ছাড়া। তার মানে যো কোনো সময় যে কেউ বড় সংকটে পড়ে যেতে পারে। চলছে চলুক বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া মোটেই শুভকর হতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক