ইসলাম ও আনন্দ-বিনোদন
জীবনের উদ্দেশ্য শান্তি। শান্তির জন্য ধর্ম, কর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি। শান্তি আসে আনন্দ থেকে। আনন্দ আসে বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, বিনোদন থেকে। হতে পারে সেটা ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক। কিন্তু আনন্দ উৎসবকে এক শ্রেণির আলেম, মোল্লা, মৌলভিরা ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে ইসলাম ধর্মকে নিরামিষ ধর্মে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। ইসলামে গান করা যাবে না, নাচ করা যাবে না, বাজনা বাজানো যাবে না, খেলা করা যাবে না, মেলা করা যাবে না, নৌকা বাইচ চলবে না, যাত্রা, নাটক, সিনেমা, সার্কাস চলবে না। এগুলো ওহাবি চেতনার ফসল। এমনকি ওহাবিদের মতে, মিলাদ, শিরনি, পীর-মুর্শিদ এবং তাদের মাজার সব বেদাত, চলবে না। তারা হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মাজারও ভেঙে ফেলেছিল। ওহাবি অনুসারীরা খুবই রক্ষণশীল। ওহাবি আধিপত্যের পূর্ব পর্যন্ত ইসলাম ছিল আমিষে ভরপুর। গান-বাজনা, খেলাধুলা, মেলা, আনন্দ-বিনোদন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইসলাম ছিল ভরপুর, সতেজ, প্রাণচঞ্চল। উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, অটোমান, সালতানাত, মুঘল প্রভৃতি আমলের রাজা, বাদশাহ, খলিফা, স্থানীয় শাসকরা, সমাজপতিরা ছিলেন আনন্দ-বিনোদন অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। এক মাস রোজা রাখার পর আসে ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ। আনন্দের দিনে মানুষ আনন্দ করবে, নাচ-গান করবে, খেলাধুলা করবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, ক্রীড়া-কৌতুক করবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একদল ফতোয়া দিয়ে বেড়ায় এগুলো ঠিক নয়, ইসলাম সম্মত নয়, বেদাত ইত্যাদি। আগে বিয়ে বাড়িতে, খৎনা বাড়িতে গীত-বাজনা, নাচ হতো, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইসলাম বিরোধী প্রচারণার কারণে।
দেখা যাক, আল্লাহ ও রাসুল (স.) এ ব্যাপারে কী বলেছেন। আল্লাহ পাক গান-বাজনা, ক্রীড়া-কৌতুক, আনন্দ-বিনোদনকে নিষিদ্ধ করেননি। তিনি পবিত্র কোরআন মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ, শুকর মাংস, ব্যভিচারকে হারাম করেছেন। যদি তিনি গান-বাজনাকে অপছন্দ করতেন, তাহলে অবশ্যই কোরআনে তা সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকত। আল্লাহ যেখানে সংগীতকে নিষিদ্ধ করেননি, সেখানে একজন মোল্লাহ-মৌলভি কি তা নিষিদ্ধ করার অধিকার রাখেন? এবার দেখা যাক এ ব্যাপারে রাসুল (স.) কী বলেছেন?
হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজেও সংগীত, ক্রীড়া কৌতুক বা আনন্দ বিনোদনমুখী মানুষ ছিলেন। এর স্বপক্ষে অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ঈদের দিন দুইটি মেয়ে আমার কাছে দফ (ঢোল) বাজিয়ে গান করছিল। এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে এসে চাদর মোড়া দিয়ে শুয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) আগমন করেন এবং মেয়ে দুইটিকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘রাসুল্লাহর গৃহে শয়তানের বাদ্যযন্ত্র! এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ বলেন, হে আবু বকর! তাদেরকে বাধা দিও না, কেন না আজ ঈদের দিন।’
হযরত আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তিনি তাকে এক আনসারের সঙ্গে বিয়ে দেন। তিনি মেয়েটিকে তার স্বামীর গৃহে রেখে আসেন। হযরত আয়েশা (রা.) প্রত্যাবর্তনের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মেয়েটিকে তার স্বামী গৃহে রেখে এসেছ? উত্তরে আয়েশা (রা.) বলেন, হ্যাঁ’।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি এমন কাউকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছ যে গান গাইতে পারে? তিনি বলেন, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি তো জানো আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়’।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার পাশে বসে এক দাসী গান গাইছিল। এমন সময় হযরত ওমর (রা.) আগমন করেন এবং ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চান। হযরত ওমরের আগমন টের পেয়ে দাসীটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেই রাসুল (স.) মুচকি হাসি হাসছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন হাসছেন? রাসুল (স.) এরশাদ করলেন: দাসী আমাদের পাশে বসে গান করছিল। তোমার আগমন টের পেয়ে সে পালিয়ে যায়। হযরত ওমর বলেন: আপনি যা শুনেছেন আমি তা না শোনা পর্যন্ত দাসীকে ছাড়ছি না। অতঃপর মহানবী (স.) দাসীকে ডেকে গান শোনাতে বললেন।’
মুসাদ্দার (র.)-হযরত রুবাই বিনত মুআবিয়া ইবন আদরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী এলেন এবং আমার চাঁদরের উপর বসলেন। সে সময় আমাদের কচি মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাৎপ্রাপ্ত আমার বাপ চাচাদের শোকগাঁথা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলে ফেলল যে, আমাদের মধ্যে একজন নবি আছেন, যিনি আগামী দিনের কথা জানেন। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, এ কথা বাদ দাও এবং তোমরা পূর্বে যা করছিলে তাই কর। অর্থাৎ তোমরা পূর্বে যে গান করছিলে তা কর।
হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘সফরে রসুলে (স.) এর জন্যে হুদি পাঠ করা হত। উটের পেছনে হুদি পাঠ করার প্রথা রাসুল (স.) এবং সাহাবায়ে কেরামের যমানায় সব সময় চালু ছিল। হুদি এক প্রকার কবিতাই, যা সুললিত স্বরে ও ভারসাম্যপূর্ণ সংগীত সহকারে পাঠ করা হত। এতে উটের গতিবেগ বেড়ে যেত। সাহাবিদের মধ্যে কেউ এটা অপছন্দ করেছেন বলে বর্ণিত নেই; বরং মাঝে মাঝে তারা এটা করার অনুরোধ করতেন।’
ঈদ, বিবাহ, আকিকা প্রভৃতি আনন্দানুষ্ঠানে রাসুল করিম (স.) বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার পছন্দ করতেন।
তিনি বলেন, ‘গিরবাল বা খঞ্জনি বাজিয়ে হলেও তোমরা বিবাহ ঘোষণা কর।’ গিরবাল বা খঞ্জনি ছিল নিম্নস্তরের বাদ্যযন্ত্র। তাই উচ্চ স্তরের বাদ্যযন্ত্রের সামর্থ না থাকলে খঞ্জনি বাজিয়ে হলেও শুভ বিবাহ কর। হযরত আলী (রা.) ও বিবি ফাতেমার বিয়েতে বিখ্যাত সংগীতঙ্গ আমর ইবনে উমাইয়া জারিমি ‘দায়রা’ নামক গোল তাম্বুরা বাজিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয় যে, মৌলভিরিা বিয়ে বা আনন্দোনুষ্ঠানেও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে নিষেধ করেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) এর সময়ে খোদ মসজিদে, মসজিদ প্রাঙ্গণে আনন্দ অনুষ্ঠান হতো। হাবসিরা ছিল সংস্কৃতি প্রিয়। তারা গান, নাচ, ক্রীড়া-কৌতুক করত। একবার দুইজন হাবসি ক্রীতদাস মসজিদে ক্রীড়া-কৌতুক করছিল। রাসুল্লাহ (স.) এর সঙ্গে হযরত আয়েশা (রা.) তা উপভোগ করেছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন আর আমি মসজিদে হাবসিদের ক্রীড়া-কৌতুক দেখছিলাম। হযরত ওমর (রা.) আমাকে সেখানে দেখতে পেয়ে শাসালেন। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন: হে বনী আরকাদা, তোমরা নির্বিঘ্নে খেলা প্রদর্শন কর।’
মানুষ মারা গেলে শোক সংগীত গাওয়া জায়েজ। আল খানসা ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সমসাময়িক এবং আরবের মহান মহিলা কবি। আল খানসার ভাই ছিলেন একজন বীর। তার নাম সাখর। এ বীর মারা গেলে তার বোন আল খানসা অনেক শোক সংগীত গেয়েছিলেন। রাসুল (স.) তো তা নিষেধ করেননি। আর গান যদি হারাম হতো, তাহলে দাউদ নবি, সোলায়মান নবী কি গান করত? দাউদ (আ.) এর অনেক বাদ্যযন্ত্র ছিল। (দাউদ আ. কে নিয়ে আলাদা একটা লেখায় তা আলোচনা করেছি)। মুসা নবীও গান করতেন। তৌরাতে আছে, মোশি ও ইসরায়েলের লোকেরা প্রভুর উদ্দেশ্যে গান গাইত।
কোনো কোনো সময় গান গাওয়া জায়েজ সে সম্পর্কে হযরত ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেন, ‘সাধনার সময়, জেহাদে উদ্বুদ্ধ করতে, মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে, মৃত্যু শোকে, ঈদের দিনে, বিবাহ মজলিসে, অনুপস্থিত ব্যক্তির আগমনে, ওলিমা, আকিকা, পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ ও খৎনা, হিফজে কোরআনে আনন্দ প্রকাশের উদ্দেশে গান গাওয়া জায়েজ।’ গাযযালী সাহেব পুত্র সন্তানকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণের সময় না বলে সন্তান জন্মগ্রহণের সময় বললে ছেলে মেয়ে উভয়েই গুরুত্ব পেতেন। পুত্র সন্তানের জন্য গান গাওয়া গেলে কন্যা সন্তানের জন্যও যাবে। যাহোক, সংগীত, আনন্দ অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইসলামে অবৈধ নয়, ইসলাম ধর্ম পালন করেও যে, তা করা যায় তার অনেক নজির আছে। এখানে কতিপয় সাক্ষ-প্রমাণ হাজির করা হয়েছে মাত্র। তবে উচ্চ স্বরে ডেক সেট (সাউন্ড বক্স) বাজিয়ে মানুষকে বিরক্ত করা কাম্য নয়।
রেজাউল করিম, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর। ইমেইল: rejaulkarim1975@gmail.com