তেঁতুলতলার মাঠ বৃত্তান্ত ও ভুলের খেসারত
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন উদ্বোধনকালে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের ২৪টি নির্দেশনা দিয়েছেন। ...শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীলতার চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।’ (যুগান্তর ১৮ জানুয়ারি ২০২২)।
ডিসিদের এই সম্মেলনে ঢাকার ডিসি উপস্থিত ছিলেন কি না জানি না। উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা সম্পর্কে নিশ্চয় তিনি অবগত। আর এরকম নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রী এর আগেও দিয়েছেন। তারপরও ডিসি সাহেব থানা ভবন নির্মাণের জন্য এই মাঠই বরাদ্ধ দিলেন! এতে বোঝা যায়, সরকারপ্রধানের নির্দেশনা সম্পর্কে আমলাদের মনোভাব কী রকম!
অপরদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খেলার মাঠ সংরক্ষণের গুরুত্ব স্বীকার করে বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন, কলাবাগান থানা এখন ভাড়াবাড়িতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিকল্প না পেলে এখানেই হবে থানা ভবন।
তারপরও সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হলে সবাই খেলার মাঠের গুরুত্ব স্বীকার করবে এবং এটি রক্ষা পাবে। কোনো ভবন বা জমি অধিগ্রহণ করেও থানা ভবন করা যায়; কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত সেই আলোচনার আর কোনো খবর নেই! নির্মাণ কাজও কিন্তু বন্ধ হয়নি! আর নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো, সেই মা ও তার ছেলেকে ১৩ ঘণ্টা পুলিশের আটকে রাখার বিষয়েও উপযুক্ত কোনো পদক্ষেপ নেই। আসলে যে সিদ্ধান্ত আমলারা নিয়েছে, সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা কি সম্ভব হবে?
শুধু এ বিষয়টিই নয়, সরকারের নানা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খোদ রাজধানীতেই সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য লক্ষ কোটির এত সব বড় বড় প্রকেল্প নেওয়া হচ্ছে। অথচ বিমান বন্দর সড়কের বনানীতে রাস্তার পাশ ঘেঁষেই নির্মিত হয়েছে, খোদ সড়ক বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনা। এতে এই এলাকায় যানজট আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। “...রাস্তার উপর একটি সেতু ভবন ও বিআরটিএর ভবন কীভাবে হয়–এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ দুটি ভবনের কারণেই বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে শুরু করে বিমানবন্দর পর্যন্ত পুরোটাই এখন যানজটে আটকে থাকে। নিজেরাই এ সমস্যা তৈরি করেছি। আমরা আর কত ভুল করব?’” (প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০২২)
এ ধরণের ভুল আরও আছে! অসহনীয় যানজট কমাতে রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০০ সালের দিকে। এজন্য কম উচ্চতার ১৬টি সেতু ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়ার কথা চিন্তা করা হয়; কিন্তু এরই মাঝে সরকারের দুটি সংস্থা এ ধরনের কম উচ্চতার আরও দুটি সেতু নির্মাণ করছে।
“একটি টঙ্গীতে তুরাগ নদের উপর কামারপাড়া সেতু। এটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। দ্বিতীয়টি রেলসেতু। টঙ্গীতেই তুরাগের উপর এই সেতু নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেতু দুটি নির্মাণে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। যে উচ্চতায় সেতু দুটি নির্মিত হচ্ছে তাতে এর নিচ দিয়ে বর্ষায় নৌযান চলাচল করতে পারবে না। ফলে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করতে হলে দুটি সেতুই ভাঙতে হবে। অথবা বৃত্তাকার নৌপথ চালু হওয়ার পর সেতু দুটির কাছাকাছি গিয়ে হয় যাত্রীদের নামিয়ে দিতে হবে নয়তো কোনোভাবে সেতু পার করে আরেকটি নৌযানে তুলে দিতে হবে যাত্রীদের।’’ (প্রথম আলো, ০১ মার্চ ২০২১)
এসব ভুলের জন্য দায়ী কারা? কীভাবে এই ভুলগুলো হয়? খোদ রাজধানীতে এত সব ভুল পরিকল্পনা! সারাদেশের কী অবস্থা? না কি সামগ্রিক দায়িত্বহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও গাফিলতির কারণে জনগণ তথা পুরো রাষ্ট্রকে এর আর্থিকসহ সব ধরণের দায় বহন করতে হচ্ছে! তাই এসব ভুলের দায় দায়িত্ব নিরূপন প্রয়োজন। এ ধরনের ভুল পরিকল্পনা যাতে না হয় তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিতে হবে। না হয় এ ধরনের ভুল আরও হতে থাকবে। আর জনগণ এর মাসুল দিয়েই যাবে অনন্তকাল!
এসএ/