নিয়তি বড়ই নির্মম, বড়ই নিষ্ঠুর
পৃথিবীতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার উত্তর খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন। হয়তো মনে হতে পারে এমন ঘটনা না ঘটলেই ভালো হতো, অথচ তারপরও ঘটে যায়। ঘটনা ঘটতে ভালোবাসে, হোক সেটা ভালো বা মন্দ, দুঃখ বা আনন্দের, বন্ধন বা বিচ্ছেদের। অনেক তপস্যার পর একজন মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। তিল তিল করে মায়ের শরীরের ভেতর বেড়ে উঠে আরেকটা মানুষ, মানুষের ভেতরে মানুষ, ভিন্ন এক সত্তা। তারপরও কেমন একটা টান, যা মনের টানকেও হার মানায়। মুখটা তখনও মায়ের গর্ভে। খুব অচেনা, তারপরও কেমন যেন একটা মায়ার বন্ধন ভিতরের অস্তিত্বকে অনুভব করবার জন্য ভিতরে ভিতরে পাগল হয়ে উঠে। সে অদেখা অস্তিত্বকে ঘিরে মা স্বপ্নের জাল বুনে, যে জাল চোখে দেখা যায় না তারপরও সে জাল যেন চোখের জলে সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত হয়। সুতোর জাল ছিড়ে যেতে পারে যদিও সেটা দৃশ্যমান। অথচ মায়ের স্বপ্নের জাল কখনো ছিড়ে যায় না যদিও সেটা অদৃশ্যমান। খুব অদ্ভুত একটা দর্শন যা মনস্তত্বের জটিল জটিল তত্ত্বকেও হার মানায়।
নিয়তি কোনো শব্দ নয়, কোনো বিশ্বাস নয়, কোনো বিস্ময় নয়, নিয়তি অনেক সময় পরিণতি হয়, অনিশ্চিত হয়, অস্থির হয়। প্রকৃতির সাথে আকাশের শুন্যতায় ঝুলতে ঝুলতে নিয়তি তাকে দেখে চমকে উঠে, বিস্মিত হয়। সেখানে আকাশ আয়না হয়, যা কাচের আয়নার মতো মুখোশ পড়ে থাকেনা বরং মুখ হয়ে উঠে। যে মুখ দেখে নিয়তি খুব কাঁদে, আছাড়ি বিছাড়ি খায়। নিয়তির সে চাপা কান্না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে গিয়ে বোবা হয়ে যায়, বুলেট হতে পারেনা। সে পুঞ্জীভূত বরফের কান্না বাস্প হয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনা প্রকৃতির বুকে,মাটির কাছাকাছি, মায়ের অনুভূতিতে। নিয়তি কখনো কখনো বন্ধন হয়না বরং নির্মম বিচ্ছেদ হয়। খুব অস্বাভাবিক ঘটনার জন্ম হয় তখন। যেখানে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে গিয়ে মাকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। নিজের সন্তানের জন্মটা আর দেখা হয়না মায়ের। স্বপ্নের মায়াবী মুখটা আর কখনো দেখতে পায়না মা। সন্তানও তখন সদ্যোজাত, যার গর্ভ থেকে তার জন্ম সে মা নামের মানুষটাকে তার আর দেখা হয়ে উঠেনা কোনোদিন। এমন করেই বিচ্ছেদ বেদনা হয়, জন্ম আনন্দ না হয়ে অতৃপ্ত কষ্ট হয়। মানুষের বুকটাতে একটা আর্তনাদ জমাট বাধে অথচ কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। একদিন সে জমাট বাধা আর্তনাদ হারিয়ে যায়, যেমন হারিয়ে যায় মায়ের সেই স্বপ্নের ফেলে আসা দিনগুলি। খুব নির্মম একটা কথা পেলাম–কিছু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়, নিয়তি বড়ই নির্মম বড়ই নিষ্ঠুর। কথাটা কেবল কথা নয়, হয়তো এটাই সত্য। যা সত্যের ভেতর ঢুকে হাত দিয়ে আরেক সত্যকে বের করে আনে।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নিষ্পাপ মুখটা কেমন করে যেন সময়ের আবর্তনে তর তর করে বড় হয়ে উঠে। সময় খুব অদ্ভুত হয় , যা সবকিছু পিছনে ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যায় অথচ কখনো মরে যায়না। সন্তানকে ঘিরে মা-বাবার স্বপ্ন বাড়তে থাকে, না কোনো পাবার আশায় না বরং নিজের ভিতরের একবিন্দু রক্ত থেকে জন্ম নেওয়া একটা অস্তিত্বকে মানুষ হতে দেখবার আনন্দে। অথচ নিয়তি যে খুব অসহায় হয়। একটা লাশ একদিন ঘরে আসে। মৃত্যুর জন্ম হয় সেদিন। যেদিন মৃত্যুর জন্ম হয় সেদিন মা-বাবা তাদের একমাত্র নাড়ি ছেড়া ধনকে হারায়। বুকটা আঁতকে উঠে, বিচ্ছেদ বন্ধনকে কুড়ে কুড়ে খায়, সবকিছু থেমে যায় অথচ সময় সময়ের মতোই চলতে থাকে। মা-বাবা বাকরুদ্ধ হয়, স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় নিমিষেই। নিয়তি আবার কাঁদে, বরফ গলা নদী হয় অথচ সে নদীর কোনো স্রোত থাকে না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একটা ছেলে। মা-বাবার মুখে বিশ্বজয়ের ঝলকানি যেন উথলে পড়ে। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে যায়। সময়ের পরিক্রমায় ছেলের খুব ভালো চাকরি হয়। মা-বাবার মুখ চকচক করে উঠে। ছেলেকে সংসারী করবে বলে মা-বাবা ব্যাকুল হয়ে উঠে। আবেগের সব রং ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, তীব্র কুয়াশার ভিতরেও শিশির বিন্দুর আলোতে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ছেলের বিয়ে হয়। সংসারে সুখের বর্ষা নামে, সিক্ত হয় জীবন। নাতি-নাতনির জন্ম হয়। খুব ছোট ওরা। পৃথিবীটা এখনো বুঝে উঠেনি ওই নিষ্পাপ মুখগুলো, আপন মুখগুলোই তাদের পৃথিবী। এমন এক বাস্তবতায় নিয়তি আবার যেন কেঁদে উঠে। খুব কাঁদে, প্রকৃতিও কাঁদে অথচ দূরবীন দিয়ে তারা যা দেখে অণুবীক্ষণ যন্ত্র তাকে আরও দৃশ্যমান করে তুলে। বিচ্ছেদ...বিরহ হয়। ছেলের শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা। একদিন, দুইদিন, তিনদিন এমন করে অনেকদিন, তারপরও শরীরটা শরীরের বশে নেই। ইট-পাথরের নামকরা হাসপাতাল তখন গন্তব্য হয়। গন্তব্য তো গন্তব্যই, সব গন্তব্য ঠিকানা খুঁজে পায় না। কে যেন নিভৃতে দাঁড়িয়ে একটা চিঠি লিখে, সে চিঠির প্রাপককে কোনোদিনও খুঁজে পাওয়া যায়না। কারণ লালচিঠির বাক্সটা তখন অনেক পুরাতন, ডাকপিয়নের পিছনে ঝুলানো ঝুলিটাও অপ্রচলিত। ছেলের ক্যান্সার ধরা পড়ে, লাস্ট স্টেজ। ছেলে বৌ, সন্তান, মা-বাবার মুখগুলো দেখে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকে যদিও সে জানে এই স্বপ্ন দেখার কোনো মূল্য নেই। পৃথিবীতে একটা অদ্ভুত নিয়ম সব সময় কাজ করে তা হলো মানুষ যখন তার মৃত্যুর দিন গুনতে থাকে তখন তার বাঁচার আকাঙ্খা বাড়তেই থাকে। একদিন সত্য সত্যই হয়ে উঠে, যেটা মিথ্যেকে যাচাই করা নয়, যেটার নাম হয় নির্মম সত্য। একদিন বাড়িতে লাশ আসে। সবাই কাঁদে....। তারপর সময় আবার সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়, সবকিছু মরে যায়, সময় তখনও বেঁচে থাকে। আর নিয়তি নিয়মের বেড়াজালে বন্দি হয়। সে বন্দিত্বের শিকল ভেঙে নিয়তি কখনো মুক্তির পথ খুঁজে পায় না।
খুব মনে পড়ছে সুকান্তের কথা। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘কবি হওয়ার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো তার।’ অথচ এই ক্ষণজন্মা মানুষটা যতটুকু সময় পেয়েছেন ততটুকু সময়ে কলম যেন আগুন হয়েছে। সে পোড়া আগুনে কলমের কালি একটু একটু করে শুকাতে শুকাতে জন্ম দিয়েছে কবিতার, অনেকটা তার জীবনের মতো যেখানে জীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। তার কবিতার মধ্যে তিনি নিজে ছিলেন না, মানুষ ছিল, জীবন ছিল, দ্রোহ-বিদ্রোহ ছিল। অথচ নিয়তি খুব নির্মম হয়ে বসে ছিল। মাত্র একুশ বছর বয়সে সুকান্তের যক্ষা হলো। সে সময়টাতে যক্ষার কোনো ওষুধ ছিলোনা, চিকিৎসা ছিল না, মৃত্যুই ছিল একমাত্র গন্তব্য। ছাড়পত্র লিখেছিলেন সুকান্ত, সে ছাড়পত্র তাকে নিতে হলো। সময় খুব অদ্ভুত এখানটায়। এখন যক্ষার ওষুধ বেরিয়েছে অথচ সুকান্ত জন্মেছে এর অনেক আগে। যদি সুকান্তকে আবার ফিরিয়ে আনা যেত এই সময়টাতে তবে হয়তো একজন মহাকবির জন্ম হতো। যদিও সুকান্ত যতটুকু লিখছেন ততটুকুই তার কবিতাকে অমরত্ব দিয়েছে, সুকান্তের দেহের মৃত্যু ঘটলেও তার দর্শনের মৃত্যু ঘটেনি। সুকান্ত কবি ছিলেন যতটা দার্শনিক ছিলেন তার থেকে অনেক বেশি। সব মরে যায়, কবি ও কবিতা যখন আগুন হয় তখন তা বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ ধরে। সব কিছুই ঠিক ছিল কিন্তু ফুল ফোটাবার আগেই ঝরে গিয়েছিলো। অপূর্ণতার কষ্ট এখানেই...যা নিয়তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। আর নিয়তির কষ্ট সেখানে যেখানে নিয়তির করার কিছুই ছিলোনা। সব স্বপ্ন সত্য হয়না, সব সত্য স্বপ্ন হয়না। জীবনের টানপোড়েনটা বুঝি এখানেই।
মানুষ মানুষই, সব স্বপ্ন। সব আয়না, টুকরো কাচের মতো। এরপর নিয়তির যাত্রা কোন পথে কে জানে। অপেক্ষা সময়ের....সময় কাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে সে বিচার সময়ের। প্রকৃতি প্রকৃতিই, সব বুঝে, সব দেখে তারপরও বুকে পাথর বাধে। এখন আর কেউ কাঁদে না। কান্নার অভিনয় করে। মানুষ তো এখন আর মানুষ নেই বরং অনেক বড় অভিনেতা হয়ে গেছে। রাজনীতির নেতা হয়ে গেছে। আবেগ জলে ডুবে মরেছে, বিবেকও মরেছে। তারপরও চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরে একটা নতুন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে। হয়তো সেটা ভালোই হবে। তবে কতটা ভালো সে বিচার মানুষের নয়, অন্য কারো, অন্য কারো নয়, মানুষের। সবকিছুই অংকের খেলা, সবকিছুই সমীকরণ তারপরও খুব অনিশ্চিত।
এত কিছুর পরও, জীবন একটা চলন্ত ট্রেন হোক, মানুষ তার যাত্রী হোক যেখানে অনিশ্চয়তার মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখবে, জীবনের গান গাইবে। থেমে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, ফিরে আসা–এমনটাই বিশ্বাসের শেকড়ে ঝুলে থাকবে, সেখানে কেউ থাকুক বা না থাকুক। কারণ শূন্যতা কখনো কখনো নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক
অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
এসএ/