কিশোরীদের দেখা একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি
মধুবন্তী ডায়েসের গল্পঃ
[ ১] আমি মধুবন্তী, সবাই এই নামে চিনেন। পুরো নাম মধুবন্তী ডায়েস। আমার আব্বার আসল নাম আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ। আমার দাদা পর্যন্ত মুসলমান ছিল। আমার আব্বা আর ছোট কাকা খ্রিস্টান হয়ে যায়। কারণটা আমার সঠিক জানা নেই। কেউ কেউ বলে, মা খ্রিস্টান ছিল তো, মাকে ভালোবেসে আব্বা খ্রিস্টান হয়েছে। তা না হয় মানলাম। কিন্তু ছোট কাকা কেন খ্রিস্টান হলেন। খ্রিস্টান হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন আশরাফ কুমার খন্দকার। আমরা সাত ভাই বোন। তিন বোন আর চার ভাই। আমিই সবার ছোট।
আমার আব্বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই দেশ থেকে চলে আসেন। প্রথমে আব্বা একা আসেন। তারপর আস্তে আস্তে আমার বড় ভাইদেরকে নিয়ে যায়। আর যুদ্ধের তিন চার বছর পর আমরা সবাই চলে আসি। আমার দাদা-দাদীমাকেও আনার জন্য অনেক চেস্টা করেছিল আব্বা। কিন্তু তারা কিছুতেই আসেননি। আব্বা খ্রিস্টান হওয়ার পরও দাদার বাড়িতে যোগাযোগ ছিল। আব্বা যাওয়া আসা করতেন। কিন্তু দাদা দাদীরা কেউ আব্বার কাছে কখনোই আসেননি। আমার দাদা-দাদীমা খুব কস্ট পেয়েছিলেন। এগুলো নিয়ে অনেক কিছু হয়েছিল। আমার মনে হয় সেই দু:খে অভিমানে আব্বা দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন। দাদা-দাদীমার কস্ট পাওয়ার মতন যথেস্ট কারণ তো আছেই। সন্তান বড় হয়ে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু এমন কিছু করা উচিৎ নয় যাতে বংশ, মা বাবার মাথা নিচু হয়ে যায় সমাজে এবং বড় কস্ট পেতে পারে। আমি মনে করি আমার আব্বার দোষ। এমন কিছু ঘটেনি যে, নিজের বাপ দাদার ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহন করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স কতই বা হবে, ১৩ কি ১৪ বছর। এর বেশি তো আর না। যখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে; সারা দেশের মানুষ আশ্রয়হীন অসহায় হয়ে পড়েছে; ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই; মেয়েদের মান ইজ্জত নিয়ে রাস্তা-ঘাটে, ঘরে-বাহিরে কোথাও কোন নিরাপদ আশ্রয় ছিল না; সবাই যার যার জীবন বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত; দিন নেই, রাত নেই মিলিটারিদের চোখে পড়লেই একটা গুলির শব্দ আর পরে মরে যাওয়া; সেই দুর্দিনে, অসময়ে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়ি। আমাদের পাশে কেউ নেই। কোথায় যাব, কি খাব, কিভাবে থাকবো, আশ্রয়হীন এত বড় একটা পরিবার। তখন সৃষ্টিকর্তার মতন একদিন গিয়ে দাদা উপস্থিত হলেন আমাদের বাড়িতে। সেইদিনের আগে কোন দিন দাদাকে দেখিনি, নাম শুনেছি। যখন দাদা গিয়ে তার নাম বললেন, আমরা সবাই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, কেন গিয়েছে, ভাল না খারাপ উদ্দেশ্য ছিল। আমরা ভয় পাব, না আনন্দিত হব। দাদা তার পরিচয় দিয়ে মাকে বললেন, দেশের পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়ে পড়েছে। এখানে তোমরা মোটেও নিরাপদ না। তোমরা আমার সঙ্গে চল। খুব বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কিছু নিবে না। রাস্তায় কোন গাড়ি-ঘোড়া নেই। হেঁটে যেতে হবে। আর হাঁটাও নিরাপদ না। আমি যে এসেছি, খুব খারাপ অবস্থা দেখে এসেছি।
সেইদিন দাদাকে আমার সৃষ্টিকর্তা মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা বুঝি নিজে দাদাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। দাদার এক কথায় আমরা চলে গিয়েছিলাম দাদার সঙ্গে। তখন বুঝতে পারিনি। পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি। সন্তানের জন্য মা বাবা সবই করতে পারে। যুদ্ধের পুরো সময় দাদা আমাদেরকে ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে রেখেছেন। দাদীমাও কম করেননি। যুদ্ধ শেষ হলে মা আমাদের বাসায় এসেছিল। এসে দেখে সেই বড়িঘরের কোন অস্তিত্বই নেই। মা আবার ফিরে যায়। আমেরিকায় আসা পর্যন্ত আমরা দাদা দাদীমার সঙ্গে তাদের বাড়িতে ছিলাম। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় সেই সময়টুকু যতদিন দাদা দাদীর সঙ্গে ছিলাম। আব্বাকেও তো কখনো সেইভাবে কাছে পাইনি। যুদ্ধের আগে দুই একবার মনে হয় এসেছিল কিছুদিনের জন্য। তখন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে আব্বার কত রকমের কত কাজ ছিল। আব্বার সঙ্গে যেহেতু থাকতাম না সেহেতু আব্বার সঙ্গে তেমন একটা সম্পর্কও আমার ছিল না। আর আব্বার সময় বা সুযোগ ছিল না আলাদা করে আমাকে সময় দেয়ার। তাই আব্বার প্রতি তেমন কোন টানও ছিল না। দাদা-দাদীমার কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি, তা আমি জীবনে কারো কাছ থেকে পাইনি আর পাবো-ও না। তাদের কাছ থেকে শিখেছি, দেখেছি, কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, ভাল রাখতে হয় এবং সত্যিকারের মানুষের মতন মানুষ হওয়া যায়। দাদা-দাদীমা মারা যাওয়ার পর আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
আমরা ঢাকায় থাকতাম। আর দাদার বাড়ি ছিল খুলনায়। আমরা ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লেগেছিল পাঁচ দিন। কোন গাড়ি তখন চলছে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা কোথায় যাব কিভাবে যাব, এসব নিয়ে চিন্তা করছেন। তখন তো মা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই মা হিমশিম খাচ্ছে। কি করবো, কি করা উচিত। মা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। ঘরের ভেতর বসে বসে শুধু কান্নাকাটি করতো সবাইকে নিয়ে। চার দিন শুধু গুলির শব্দ। মানুষের আহাজারি। ভয়ে আতংকে মিলিটারিদের ভয়ে রাস্তায় কুকুরও যেত না। আকাশে পাখিও উড়তো না। ভোরে মুরগিও ডাকতো না। শুধু গুলির শব্দ আর গুলির শব্দ। এমন অবস্থায় এতগুলো মানুষ নিয়ে ঘর থেকে বাহির হওয়ার সাহস পায়নি মা । দাদা এসে বলার পর মায়ের মনে হয় দেহে জান ফিরে এল। ঢাকা থেকে আমরা রাত খুব সম্ভব এগারটার দিকে রওনা দিয়েছিলাম। হাঁটা না শুধু দৌড়াতাম। দাদা সঙ্গে করে গ্রাম থেকে আরও দুইজনকে নিয়ে এসেছিল । ঢাকা শহর ছাড়ার পর আমরা গরুর গাড়ী আর পায়ে হেঁটে পাঁচ দিনে গিয়ে পৌঁছালাম দাদার বাড়িতে। রাস্তায় দুই জায়গায় মিলিটারিদের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। তখন তো সব জায়গায়ই মিলিটারি ছিল। দ্বিতীয় দিন যখন হাঁটছি, হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর কাছে চলে যাই। নদীর পার দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ নদীর দিকে চোখ পড়তেই দেখি, পানি কেমন যেন লাল। মনে মনে ভাবছি পানি লাল কেন। আবার তাকালাম আমার দেখতে মনে হয় ভুল হয়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটছি তো, সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তাই ঝাপসা দেখছি। আবার দেখি লাল। তারপর চোখে ডলতে ডলতে ভালভাবে পরিস্কার করে তাকিয়ে দেখি, না, আমি যা দেখছি তা ঠিকই, পানি-ই লাল। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠি। তখন কে যেন বলছে, কি হয়েছে। আমি বলি, পানির দিকে তাকাও, নদীর পানি দেখ কেমন। তখন সবাই দাঁড়িয়ে। দাদীতো বুঝে ফেলেছেন ঘটনা কি। দাদা বলছেন, দাঁড়াও, কেউ হেঁটো না। সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছি। আমাদের সঙ্গে আরও ২৫/৩০ জন হবে। তারা কে বা কারা, কেউ কাউকে চিনে না। অথচ আমরা একই সঙ্গে যাচ্ছি। কারো সঙ্গে কোন কথাও হচ্ছে না।
দাদা বাড়িতে চার পাশটা ভাল করে দেখলেন। দেখেন, সামনে একটা ঝোপঝাড়ের মতন আছে। তা দেখে দাদা বললেন, তোমরা ঐ ঝুপের ভেতরে গিয়ে বস, আমি পরিস্থিতিটা দেখে আসি। আমরা নদীর পারে বসে আছি। দেখি, রক্তে নদী লাল হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটু পরেই দেখি একটা লাশ ভেসে আসছে। তারপর দেখি, লাশের পর লাশ ভেসে আসছে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সব বয়সের লাশ। এসব দেখে নিজের চোখকে বিশ^াস করতে পারছি না যে এত লাশ। আহা! লাশের পর লাশ। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে একবার ভাসছে, আবার ডুবছে। এক এক করে বয়ে যাচ্ছে। জানিনা কোথায় গিয়ে থেমেছিল। কি হয়েছিল সেই লাশগুলির। নদীর মাছে খেয়েছিল, না কুমিরে। না নদীর কিনারে গিয়ে আটকেছিল, না কোন শিয়াল, কুকুরে খেয়েছিল। না কেউ তাদের লাশ দেখে চিনতে পেরে তুলে মাটির নীচে রেখেছিল। কত লাশ ছিল তাও জানিনা, জানিনা কি ছিল তাদের অপরাধ। কি কারণে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।
এসব দেখে চোখ যেমন নদীর দিকে আটকেছিল । ঠিক তেমনি পা আটকে গিয়েছিল মাটিতে। যতই হাঁটছি না কেন, পা আর চলছে না। পথ আর ফুরাচ্ছে না। আর এদিকে সবাই তাড়া দিচ্ছে হাঁটার জন্য। আমরা ৩০/৩৫ জন লোক হাঁটছি, কোন কথা নেই, শুধু একটাই শব্দ, তাড়াতাড়ি হাঁট, তাড়াতাড়ি, সামনে বিপদ। একটা নিরাপদ আশ্রয় নিতে হবে। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর দূরে দেখা যাচ্ছে একজন লোক দৌড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ইশারা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। দাদা বুঝতে পেরেছে মনে হয়। দাদা আবার হাঁটা থামিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। ঐ লোকটি তার দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে ছুটে আসছে। কাছাকাছি এসে বলছে, তোমরা সামনের দিকে যেও না। সামনে মহা বিপদ। মিলিটারি এদিকে আসছে। তোমাদেরকে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবো। তখন সামনেই একটা জঙ্গলের ভেতরে আমরা সবাই চলে যাই। সারা দিন সেই জঙ্গলের ভেতরেই ছিলাম। সন্ধ্যার সময় জঙ্গল থেকে বাহির হয়ে আবার হাঁটতে থাকি। ঐ এলাকায় কোন ঘরবাড়ি ছিল না। আরও তিন চার ঘন্টা হাঁটার পর দুই একজন লোক দেখা গিয়েছে। দাদা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, সামনে জঙ্গল, কোন পথ-ঘাট নেই। নদী পার হতে হবে। পরে আবার হাঁটার রাস্তা আছে। সামনেই নদীর ঘাট আছে। গেলাম ঘাট পর্যন্ত। ঘাটে গিয়ে দেখি শত শত লোক পার হচ্ছে। ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে পার করছে কয়েকজন যুবক ছেলে। নৌকায় কোন বৈঠা নেই, লাইন ধরে পার করছেন তারা। আমরা পার হতে হতে ভোর হয়ে গিয়েছে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক