চাকর-চাকরজীবী-পেশাজীবী-পেরেশানি!
এক সময় গবাদি পশুর মতো ‘মানুষ দাস’দের বিষয়েও একই মনোভাব পোষণ করত ‘মানুষ মালিক’রা। সময়ের পরিক্রমায় বর্বর এই প্রথার বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগের ‘মানুষ মালিকে’র মনোভাবের কি পরিবর্তন হয়েছে?
এখন মজুরির বিনিময়ে চাকর-গৃহভৃত্য রাখা হয়। একইভাবে আমরা যারা শ্রমের বিনিময় মূল্যে চাকরি করি, তাদের প্রতি মানুষ-মালিক তথা চাকরিদাতাদের মনোভাব কী রকম?
প্রায় ৩৫ বছরের চাকরজীবন তথা চাকরিজীবন পেরিয়ে এসে এই উপলদ্ধি হলো যে, কোথাও মানসিক বর্বরতার শেষ নেই! দেখেছি, কথিত করপোরেট প্রতিষ্ঠানের গণমাধ্যম মালিকের কেউ কেউ অনেক বেশি শিক্ষিত হলেও ‘দাস মালিকে’র মনোভাবের বাইরে যেতে পারেননি। তারা ভাবেন, তারা সবকিছু জানে! সবকিছু পারে! তথ্যপ্রযুক্তি, সাংবাদিকতা, পণ্য উৎপাদন, কেনা-বেচা, পশু প্রাণী লালন পালন থেকে শুরু করে সবকিছুই তাদের নখদর্পণে! তাই তাদের আচরণও সেরকম! আর যারা এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে অবদান রাখতে চান, তারা হয়ে পড়ে গৃহভৃত্যের মতো অসহায়! যতই পেশাজীবী হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে না কেন, নেহাৎ চাকরজীবী বা চাকরিজীবী ভাবতে বাধ্য হয়!
আরেক শ্রেণির মালিকের কথাও জানি, যারা তথাকথিত পেশাজীবী থেকে ভাগ্যক্রমে মালিকের পর্যায়ে উন্নতি করেছে বা মালিকের প্রতিনিধিত্ব করছে; তারাও একই মনোভাবে দুষ্ট! বাংলাদেশে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের রুগ্ণ অবস্থার জন্য অন্য অনেক বড় বড় কারণের সঙ্গে এটিও একটি প্রধান কারণ বলে মনে করি! তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা এখন সন্ধিক্ষণে। অনেক চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন। বেশিরভাগ মানুষ এখন আগের মতো টিভি দেখে না, পত্রিকা পড়ে না। মোবাইলই সবকিছুর তথা ডিজিটাল মিডিয়ার আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রুগ্ণ দুয়েকটি পত্রিকা বন্ধ হলেও কোনো টিভি চ্যানেল এখনও বন্ধ হয়নি। আর প্রায় সবক’টি চ্যানেল সংবাদ প্রচার করে। চ্যানেলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বা নিউজ চ্যানেলই ৮টি হওয়ায় সব চ্যানেলে সংবাদ বিভাগ রাখার কি প্রয়োজন আছে? বিশেষ করে নিউজ চ্যানেলগুলো যেখানে তাৎক্ষণিক সব খবর দিচ্ছে, সেখানে মিশ্র চ্যানেলগুলোর পক্ষে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর স্বার্থে প্রায় সব মিশ্র চ্যানেলের মালিকরা ছোট করে হলেও সংবাদ বিভাগ রেখেছে! এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
এ তো গেল সংবাদমাধ্যমের মালিকানা নিয়ে সাতকাহন। আর আমরা যারা তথাকথিত পেশাজীবী হিসেবে, সমাজের দর্পণ হিসেবে নিজেদের গৌরাবান্বিত বোধ করি, তারা আসলে কেমন আছে?
আর কোন পেশায় এত হাতুড়েপনা আছে কি না জানা নেই! এজন্যই কি ‘সাংবাদিক’ শব্দটা ‘সাংঘাতিকে’ পরিণত হয়েছে? আর এখন তো অনলাইন সাংবাদিক, ফেসবুক বা ইউটিউব সাংবাদিক বা অন্য কোনো পরিচয়ে যে কেউ যখন তখন এই শব্দটা ধারণ করতে পারে এবং বেচা-বিক্রিও করতে পারে! এই শব্দের দৌরাত্ম্য মফস্বল এলাকায় আরও বেশি! কত নামের সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস ক্লাব! যেন চাঁদাবাজি ধান্দাবাজির আড্ডাখানা। এতে একসময় এই শব্দটার যে মহাত্ম্য ছিল, তা এখন ধূলিস্মাৎ।
ভালো কোনো সংবাদমাধ্যমে এই পেশার লোকজনও যে ভালো বেতন ভাতা পায় তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না! অনেকের কাছে গাল-গল্পের মত মনে হয়। তাই তো সচেতন কেউ মূল ধারার সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতেও সংকোচ বোধ করে! মানুষ এই পরিচয়ধারীকেও সন্দেহের চোখেই দেখে! সঙ্গে সঙ্গেই বলে দেয়, অমুক চ্যানেল বা পত্রিকার সাংবাদিকরা নাকি বেতন পায় না! প্রায়ই তো দেখি, বেতন ভাতা বা ওয়েজ বোর্ডের জন্য সভা-সমাবেশ, আহাজারি! সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকতা নিয়ে এসব নেতিবাচক মনোভাবের উত্তর দেবে কে? আর ভালো সংবাদমাধ্যম বা ‘সাংবাদিকে’র সম্মান কীভাবে পুনরুদ্ধার সম্ভব?
লেখক: সাংবাদিক
এসএ/