বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর
বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তেন। গৃহশিক্ষকরাই তাকে উদার মানসিকতার করে তৈরি করেছে। তিনি তাঁর আত্নজীবনীতে লিখছেন যে, তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন সাখাওয়াত স্যার। তখন তাঁর বয়স ছিল দুই কিংবা তিন। স্যার তাঁর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন,বঙ্গবন্ধু তাঁর লাগেজ মাথায় করে নিয়ে নদীর ঘাটে দিয়ে এসেছেন। এরকমই ছিল শিক্ষকদের প্রতি তাঁর অনুরাগ ভালবাসা সম্মান। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ। তাঁর সাথে শৈশবের অনেক সৃতিকথা আছে। তিনিই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটুকু বিপ্লবী করে তুলেছেন। পরবর্তীতে তিনি সমাজকল্যাণের কাজেও তার অবদান রেখেছেন। মুসলিম ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন যেটি সেটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেক্রেটারি। তখন গোপালগঞ্জে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত থেকেছেন। গরিব ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করতেন। খুব বন্ধুবৎসল ছিলেন। বন্ধুদের যে কোন প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাদের সাথে নিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করতেন। সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর সেই স্বভাব ছিল।
ছোটবেলায় অসুস্থ হবার কারণে দুই তিন বছর সময় হারিয়ে গেছে স্কুল জীবন থেকে। যে কারণে একটু বেশি বয়সে তিনি মেট্রিক পাশ করেছেন। যেহেতু তিনি শিক্ষকদেরও খুব প্রিয় ছিলেন, যে কারণে স্পোর্টস, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সবকিছুর সাথেই যুক্ত থাকতেন এবং শিক্ষকরা তাকে খুব পছন্দ করতেন। স্কুলে থাকা অবস্থায় তিনি মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন এবং সোহরাওয়ার্দীর খুব কাছাকাছি চলে আসেন। পরবর্তীতে কলেজে পড়ার সময় তিনি শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তেতাল্লিশ সালের দুর্ভিক্ষে তিনি লঙ্গরখানা খুলেছিলেন তাঁর ছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে তিনি যে অনুভব করেছেন, তিনি তাঁর কষ্টের কথা লিখেছেন এভাবে যে, “যে দেশ সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা এবং যে দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় কি করে?”
ছাত্র অবস্থাতেই তিনি বাংলা পীড়িত মানুষের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে তিনি ছাত্রলীগ তৈরি করলেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন। আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি যে, তরুণ শেখ মুজিব সবসময় মানুষের কাছাকাছি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি ছিলেন। সাধারণ মানুষই ছিল তাঁর পাঠক্রম। তাদের কস্ট তিনি খুব কাছে থেকে অনুভব করছেন এবং তাদের কষ্ট তিনি সবসময়ই অনুভব করেছেন। সবসময়ই মানুষের কাছে থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি নিজেও একসময় বলেছেন, শিক্ষা তিন রকমের হতে পারে. ১) বই পড়ে শেখা যায়। ২) অন্যের কাছে থেকে শেখা যায় এবং ৩) করে করে শেখা যায়। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তিনি করে করে শেখার পক্ষপাতি। বঙ্গবন্ধু বড় নেতা হয়েছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কিন্তু তিনি শিখেছেন সাধারণ মানুষের কাছে থেকেই।
আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, তিনি একজন মানবিক নেতা এবং মানবিকতার পাঠ তিনি সাধারণ মানুষের কাছে থেকেই শিখেছেন। এই পাঠ প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবন থেকেই অর্থাৎ তাঁর শৈশব কৈশোর থেকেই। বড় হবার পরেও তিনি তাদের কখনও ভুলে যাননি। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেও তিনি তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষকদের যে সম্মান দেখিয়েছেন, সেটি বিরল এবং শিক্ষণীয়। শিক্ষা তো মূলত শিক্ষক নির্ভর। শিক্ষকরা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ অভিভাবক আমাদের। বঙ্গবন্ধু এটি খুবই ভাল বুঝতেন। বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে প্রকৃতির সাথে, মানুষের সাথে এবং তাঁর শিক্ষকদের সাহচর্যে।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক