ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেন পৌঁছাল মাওয়া
স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে বহুল কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুর একটা ২১ মিনিটে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে বেলা ৩টা ১৮ মিনিটে ট্রেনটি মুন্সিগঞ্জের মাওয়া স্টেশনে গিয়ে থামে।
অত্যাধুনিক সাতটি কোচ নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। পরীক্ষামূলক এই যাত্রায় যাত্রী হয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা, সাংবাদিক, সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষ। সব মিলিয়ে কয়েকশ মানুষ এই পরীক্ষামূলক ট্রেনে টিকিট ছাড়া চড়ে ইতিহাসের স্বাক্ষী হলেন।
চলতি বছরের শেষ দিকে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা লাইনে চালু হবে ট্রেন সার্ভিস। তারই অংশ হিসেবে ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে মাওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন যাত্রা শুরু হলো। এর মধ্য দিয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি মাইলফলক স্পর্শ করছে বাংলাদেশ।
চীন থেকে কেনা নতুন ৭টি কোচ দিয়ে তৈরি করা একটি বিশেষ ট্রেন দিয়ে পদ্মা সেতুর রেলপথে প্রথম ট্রায়াল রান অনুষ্ঠিত হলো।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন থেকে বিশেষ ট্রেনে করে পদ্মা সেতুর পার হন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেনের ট্রায়াল রানের জন্য সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা থেকে একটি বিশেষ ট্রেন ফরিদপুরে নিয়ে আসা হয়।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে গত সপ্তাহে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এর ফলে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত রেললাইনের কাজও শেষ হয়েছে। তাই চীন থেকে কেনা নতুন কোচ দিয়ে একটি বিশেষ পরীক্ষামূলক ট্রেন আজ ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত চলাচলের মাধ্যমে ট্রায়াল করা হলো।’
তিনি বলেন, ‘আশা করছি সেপ্টেম্বরের কোনো এক সুবিধাজনক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ভাঙ্গা থেকে মাওয়া এ রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করবেন।’
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালে জুনের মধ্যে শেষ হবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। পদ্মার মূল সেতুতে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে গত সপ্তাহে।
গত ২৫ মার্চ রাত ১০টায় সেতুর মাঝামাঝি ৫ নম্বর মুভমেন্ট জয়েন্টে ইস্পাতের সর্বশেষ স্লিপারটি বসানো হয়। এরপাশে সাত মিটার ঢালাই কাজ বাকি ছিল, যা গত ২৬ মার্চ বিকালে শেষ করা হয়। এর মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে রেল চলাচলের জন্য ১১ হাজার ১৪০টি স্লিপার বসানোর কাজ শেষ হয়।
এ বিষয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পর পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। এর আগে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হবে এ বছরের শেষ দিকে। এ পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশের কাজ প্রায় ৯১ শতাংশ শেষ হয়েছে। পদ্মার মূল সেতুতে মাওয়া-জাজিরা অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানা গেছে, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত তিনটি অংশে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশসসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রড গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
গত বছর ২৬ জুন পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রায় তিন মাস পর গত বছর ২০ আগস্ট পদ্মার মূল সেতুর জাজিরা প্রান্তে রেললাইন বসানোর কাজের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী।
মূল সেতু ও ভায়াডাক্টসহ প্রায় ৭ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন বসাতে প্রায় ৭ মাস সময় লাগে। মূল এবং দুপাশের ভায়াডাক্ট মিলিয়ে পদ্মা রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার।
রেল সেতুতে আটটি মুভমেন্ট জয়েন্ট রয়েছে। মুভমেন্ট জয়েন্টের ইস্পাতের আটটি স্লিপার ছাড়া বাকি সবগুলো কংক্রিটের তৈরি। বিশেষ তাপমাত্রায় মুভমেন্ট জয়েন্টের ইস্পাতের স্লিপারগুলো চীন থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রকল্প সূত্র জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া, ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক।
জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তা হচ্ছে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ টাকা ব্যয় হয়ে সরকারি তহবিল থেকে। মূল প্রকল্পে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ৯ হাজার ৯৫৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ব্যয়বৃদ্ধির এই প্রকল্পটিতে সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, চীন সরকার জি-টু-জি পদ্ধতিতে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। যা আগে ছিল ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণচুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্সিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।
থাকছে ২০টি স্টেশন
পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পে কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ২০টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশনই হবে নতুন। পুরোনো ছয়টি স্টেশনকে ঢেলে সাজানো হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে। কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের নিমতলায় নতুন দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর ও মাওয়া স্টেশন নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মাওয়া স্টেশনের পরে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় নির্মিত হচ্ছে ‘পদ্মা স্টেশন’। পদ্মা স্টেশনের পরে শরীয়তপুরে ‘শিবচর স্টেশন’।
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে জংশন। ভাঙ্গা থেকে একটি লুপ লাইন ফরিদপুর সদর ও অন্য একটি লুপ লাইন নাগরকান্দা পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পের আওতায় নাগরকান্দায় স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরপরে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর ও মহেশপুরে নির্মিত হবে দুটি রেলস্টেশন। এ ছাড়া, নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদরে একটি করে স্টেশন নির্মাণ করা হবে। যশোরের জামদিয়া ও পদ্মবিলে দুটি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান ছয়টি রেলস্টেশন ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। এ ছাড়া, গেণ্ডারিয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন নান্দনিক করে গড়ে তোলা হবে। সংস্কার করা হবে তিনটি স্টেশন। সেগুলো হলো, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, যশোরের সিংগাই ও রূপদিয়া স্টেশন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, কমলাপুর থেকে গেণ্ডারিয়া তৃতীয় ডুয়েলগেজ লাইন, ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশন, কমলাপুরের টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস, নড়াইলের তুলারামপুরে নতুন আন্ডারপাস এবং ভাঙ্গা স্টেশনে আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। যেসব স্টেশনে আন্ডারপাসের মাধ্যমে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়া যাবে। মাওয়া, পদ্মবিল, কাশিয়ানি, রূপদিয়া স্টেশনগুলোতে অপারেশনাল সুবিধা বাড়ানো হবে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ভাঙ্গার তুজারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, আমাদের অনেক দিনেশ আশা, এই এলাকার মানুষ ট্রেনে চড়ে ঢাকায় যাবেন।
অল্প খরচে ও নিরাপদে ঢাকা পৌঁছে দিনের কাজ শেষ করে আবার এলাকায় ফিরে আসবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের সেটি স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। এই অঞ্চলের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
ভাঙ্গা বাজারের ব্যবসায়ী জাবেদ সরদার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, জীবনে যা দেখতে পারিনি, সেটা দেখে গেলাম। এই দৃশ্য জীবনে ভুলব না। আজকে আমাদের আনন্দের দিন।
ভাঙ্গা কলেজ পাড়া এলাকার বাসিন্দা নাঈম ভুইয়া, পরীক্ষামূলক ট্রেনে চড়ে ভীষণ আনন্দিত। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যা করে দিয়েছেন তার ঋণ কোনোদিন শোধ করার নয়। আল্লাহ তাকে আরও বহু বছর বাঁচিয়ে রাখুন। আমাদের এলাকা বদলে গেছে।
ভাঙ্গার ঘারোয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সফি উদ্দীন মোল্লা বলেন, আমাদের একটা স্বপ্নের পদ্মা সেতু, সেই সেতুতে রেল সংযোগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
তিনি বলেন, এই রেল চালু হওয়ায় আমাদের এলাকার আমূল পরিবর্ন হবে। আমাদের এলাকার কৃষকরা লাভবান হবেন। তাদের উৎপাদিত সবজি সহজেই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাবে। নগরবাসী কম দামে টাটকা সবজি খেতে পারবেন।
ঘারোয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মনসুর মুন্সি বলেন, আজকে অনেক ভালো লাগছে। এত সুন্দর একটা কাজের সাক্ষী হতে পেরে আনন্দিত। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যাবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তার কারণেই আজ এ অঞ্চলের মানুষ যোগাযোগের সুবিধা পেয়েছেন। সড়ক সেতুর পর এখন ট্রেনও চালু হওয়ার পথে। এটা আমাদের বড় প্রাপ্তি। প্রার্থনা করি আল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘ জীবন দান করুন।
এনএইচবি/এমএমএ/