শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা, যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
দেশে বছরে গড়ে প্রায় ১০ হাজারের ও বেশি মানুষ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করছেন। এখন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতি মাসের গড় হিসাব করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫ জনের বেশি। এসব ঘটনার বেশিরভাগই প্রেমঘটিত কারণে ঘটেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ১৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার তথ্য থেকে এই সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ১৯৪ জনই স্কুলশিক্ষার্থী। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৬ জন কলেজের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৪ জন। আত্মহত্যা প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ১৪-১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে। এই বয়সী ১৬০ জন আত্মহত্যা করেছে। এমনকি ৭ বছরের এক শিশুও আত্মহত্যা করেছে বলে জানানো হয়।
গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে ৷ কেন বাড়ছে- এই প্রশ্নের জবাবে মনোরোগ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে এসব ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মানুষের আত্মহত্যার বিষয়ে নিয়ে মনোরোগ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, আত্মহত্যা ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সময় শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলে পরীক্ষা নেওয়া বা অন্যন্য কাজে যোগদান করছে। এজন্য তাদের অনেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত নেই, যার কারণে এসব ঘটছে।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহিদা চৌধুরী বলেন, এসমস্ত রোগীরা একাকিত্ব ও বিভিন্ন আতঙ্ক বোধ করেন। আমরা তাদের কৌশলে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যাতে পরবর্তীকালে এমন কোনো ঘটনা তারা না ঘটান। তবে এর প্রবণতা বাড়ার কারণ হচ্ছে বর্তমানে মানুষ পরিবারকে মোটেও সময় দিতে চায় না। অনেকে কাজে ব্যস্ত থাকে। পরিবার শিক্ষার্থীকে সময় না দেওয়ার জন্য বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হলো- কর্মের পাশাপাশি প্রতিটা মানুষের পরিবারকে সময় দেওয়া উচিত। মানুষ এ বিষয়ে সতর্ক থাকলে নির্দিষ্ট কাউন্সিলিং থাকলে এই ঘটনাগুলো অনেকটাই কমে আসবে।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ সারাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যার কারণে আমাদের সমাজে এই সর্ম্পকে আলোচনা বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে আত্মহত্যা রোধে শিশুকাল থেকে এ বিষয়ে পড়াশোনা থাকা দরকার। জন্মের পর মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে এবং বুঝতে পারে। যে আত্মহত্যা করা যাবে না, নিজের যত্ন নিজেই নিতে হবে। বিষয়গুলো জন্মের পর থেকে জীবনধারনের দক্ষতা চর্চার বিষয় পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা উচিত ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন বলেন, আত্মহত্যা ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্ররোচনা রোধে প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং থাকা জরুরী। তিনি বলেন, স্কুল কলেজ শিক্ষক ও সমাজের সচেতন মহলকে শিক্ষার্থীদের উপর নজর রাখতে হবে। হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না। কোভিডের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এমনতেই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। করোনার দুই বছর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মানসিকভাবে তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে না। এজন্য হঠাৎ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্ররোচনা বাড়ছে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে স্কুল কলেজে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরিবারকে সতর্ক হতে হবে পাশাপাশি মানুষের খোঁজখবর নিতে হবে। মানুষ সামাজিকভাবে এগিয়ে আসলে এসব ঘটনা কমে আসবে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, দেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তিনি বলেন, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতি মাসে যা কিনা গড়ে ৪৫ জনের বেশি। তিনি বলেন, আত্মহত্যা ঠেকাতে পরিবার ও দেশের মানুষকে সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ডটা মানুষ বেছে নিচ্ছে কেন? এটা একটা বিষয়। এই বিষয়ের ক্ষেত্রে আমার বিশ্লেষণটা হলো, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িত হয় বা জড়িয়ে পড়ে। নানা ধরনের সংকট জীবনে তৈরি হয়। সংকটগুলোকে মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ সারাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলা। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিতে হবে। তাহলেই এমন অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
তিনি বলেন, ব্যক্তির প্রয়োজনে ব্যক্তিকে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু বিষয়টা হলো আমাদের দেশের আত্মহত্যার বিষয়গুলো সামাজিক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আমরা দেখি। এসব বিষয়ে সরকারেরও একটা ভূমিকা প্রয়োজন। ‘আত্মহত্যাকে না বলুন’ এই স্লোগান সামনে রেখে এগোতে হবে। তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা রোদের যথাসাধ্য কাউন্সেলিং ও আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এসব ঘটনায় শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
কেএম/এনএইচবি/এএস