‘বিদ্যা আবরণ, শিক্ষা আচরণ’
২৮ আগস্ট বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র উদ্যোগে পুরানা পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হয়ে গেল ‘বঙ্গবন্ধু : মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ আলোচনা সভা। কমরেড মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট ভবনের ট্রাস্ট মিলনায়তনে আলোচনার শুরু হয়েছে বিকেল পাঁচটায়। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান। মূখ্য আলোচক ডা. সরওয়ার আলী, অন্যতম ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক। আলোচক ছিলেন-অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রামেন্দু মজুমদার, নাট্যব্যক্তিত্ব ও থিয়েটার সম্পাদক, মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সমকাল; সোহরাব হাসান, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার ও আবদুল হালিম, যুব ইউনিয়ন নেতা। সভাপতি শেখর দত্ত, উপস্থাপক-মুকুল চৌধুরী, ট্রাস্ট মিলনায়তন।
শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের শাহাদাতবার্ষিকীতে তাদের অত্মার শান্তি কামনা করে আলোচক, দর্শক সবাই এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।
প্রধান আলোচক ডা. সরওয়ার আলী বলেছেন, “বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে উঠুক-এজন্য জীবনের একটি দীর্ঘ সময় ত্যাগ ও সংগ্রাম করেছেন পুরো পরিবার নিয়ে। এই দেশে তখন ও এখনো কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার সবাই যে রাজনীতি করেন তা নয়; তবে তার উদ্যোগে ও নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিলেন। বাংলাদেশ তার ৫০ বছরের যাত্রাপথে অনেকবার পথভ্রষ্ট হয়েছে। তবে ঠিকই আবার সামনের দিকে এগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবন ভর যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটি চেয়েছেন, তা তার অভিজ্ঞতাজাত। ১৯৪৬ সালের ক্যালকাটা কিলিং তিনি দেখেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘এই দেশের স্বাধীনতার কথা কখন ভাবলেন?’ বলেছেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর, পর।’ তিনি এমন একজন নেতা, যার কথা ও কাজের কোনো পার্থক্য ছিল না। এমন নেতা শতবর্ষে একজনই হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াজ দি ফাইনেস্ট প্রপ্রনেট অব সেকুলারিজম (বঙ্গবন্ধু ধমনিরপেক্ষাবাদের সবচেয়ে ভালো প্রবক্তা ছিলেন)। পৃথিবীর এখনো তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। নানা ধরণের মানুষের মধ্যে নানা ধরণের স্বাতন্ত্র্য থাকা স্বাভাবিক। তবে সমস্যা তখন, যখন রাজনৈতিক কারণে সমস্যাগুলো ব্যবহার করা হয়। ‘আমি একজন মানুষ-একজন বাঙালি, মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, দুইবার নয়’-তিনি বলেছেন। এখানে হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টানরা খ্রিস্ট ধর্ম পালন করবে। তবে ধর্মহীনতা মানে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এই ছিল তার রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারির হিসেবে, এই দেশে হিন্দু ছিলেন ৩০.৫ শতাংশ আর সর্বশেষ জনশুমারিতে মোটে ৭.৮ শতাংশ। তারা মারা যাচ্ছেন, তাদের সন্তানসন্ততি কমে যাচ্ছে। তারা ওপারে চলে যাচ্ছেন। এই কী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্র? একটি ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে-এই হলো সাম্প্রদায়িকতা। এখনো বাংলাদেশ একটি দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে। এই যদি আমরা না বুঝি তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে আর পারবো না। পাকিস্তান আমলে আমাদের অংশে সাম্প্রদায়িকতার শেকড় রাষ্ট্রীয়ভাবে বপন করা হয়েছে ও তাদের মাধ্যমে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সেই দিনগুলো আমরা মুছে দিয়েছি। এখন দেশ অনেক এগিয়েছে। এখন সরকার ও এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ধর্মনিপেক্ষ, সংবেদনশীল ও মুক্তিযুদ্ধে নেত্বত্ব প্রদানকারী দল। তারপরও সাম্প্রদায়িকতা সমাজের গভীরে আস্তানা গেড়েছে। এর উৎখাত বড় চাওয়া সমাজের কাছে। আজকে বড় প্রয়োজন সমাজের ভূমিকা রাখা। একটি বড় সামাজিক আন্দোলন, কার্যক্রম বড় প্রয়োজন। সাস্কৃতিক আন্দোলন, ছাত্র-যুব সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মতো হতে হবে। ছায়ানটের মতোও। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলন অতীতে বারবার প্রয়োজনের তাগিদে হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, এদেশ থেকে আজকের অবস্থানে।”
কমরেড আবদুল হালিম বলেছেন, “আমার জন্ম ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ফলে যুদ্ধের পুরোটা সময় আমি মায়ের গর্ভে। আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এই দেশ স্বাধীন হতো না। ক্লাস এইট থেকে ছাত্র ইউনিয়ন করি। আমার বড় ভাই গোলাম হায়দারের অবর্তমানে ‘একতা’ পত্রিকা বিলাতাম। আমাদের জীবনে হিন্দু, মুসলমানের সংঘাত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে পর্যায়ক্রমে সমাজেও বিস্তৃত হয়েছে। ফলে আমাদের প্রশ্ন জাগে, এই যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখছি, সত্যিকারই কী তা সকল ধর্মের ও সমানাবস্থানের?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেছেন, “আজকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এই বিশেষ আয়োজনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাদের দেওয়া এই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। তাহলে সমস্যাটি আসলে কোথায়? সেই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় মুক্তিসংগ্রামের তুঙ্গ সময়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তার একটি ডাকে শেষবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই আত্মদানের মূল চেতনা ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আমাদের দেশের মূল চেতনা মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আজকের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বারবার আক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যে আমরা খুন করতে পারি, তাকে হারাতে পারি-এই আমাদের চিন্তারও অতীত। মহা দুর্ভাগ্য। তারপরও আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে রাজনীতির মাঠে আনতে হবে। এই বাংলাদেশের জন্যই কী তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আপনারা সংগ্রাম করেছেন? বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার পর কবি শামসুর রাহমান মানিকগঞ্জে সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হবার স্থানে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে দেখতে এখন আপনারা হাজার, হাজার মানুষ; তখন আপনারা কী করেছেন?’ বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তার আদর্শে জীবন চালনা ও এই দেশকে পরিচালনা করছেন। তারা আমাদের জন্য কী দেশ তৈরি করেছেন? বিচারহীনতার রাজনীতি যে বাংলাদেশে চলছে, সেখানে আদশ শক্তিশালী না করলে দেশটি বাঁচবে না। বঙ্গবন্ধু তার নিজের জীবনাদর্শকে কখনো বিক্রি করেননি। ক্ষমতার দিকে তিনি ধাবিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করেছি। তাকে আমাদের সমস্যাগুলো জানিয়েছি। এই দেশে আমাদেরকে আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের বার্তাগুলো তরুণদের মধ্যে আরো পৌঁছে দিতে হবে। কেন আমাদের ঘরে, ঘরে আগুন জ্বলবে? যেখানে মানবাধিকার লংঘিত হবে, সেখানে আমরা সবাই মিলে স্বোচ্চার হব। কারণ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বাংলাদেশী না হলে আমাদের মাতৃভূমি টিকবে না।”
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, কলামিস্ট ও কবি সোহরাব হাসান বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা স্মরণ করছি কিন্তু স্মরণে নিতে পারিনি। মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তবে ছাত্র ইউনিয়ন তার ও তাদের হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে এগিয়ে এসেছে। তারা ১৯৭৫ সালের ৯ নভেম্বর মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সেখানে জাতিগত হত্যাকান্ড ও সংঘাতের বিপক্ষে শ্লোগান ছিল-‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। এখন ডিজিটাইল আইনে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে গ্রেফতারের বিধান আছে। কেন? আমরা আগেই জেনেছি এখন বাংলাদেশের হিন্দুদের পরিমাণ কত কমে গিয়েছে। তারপরও আমরা ভালো আছি। অথচ ভারত ও পাকিস্তানের কাশ্মীরে ৭০ বছর ধরে সংগ্রাম ও সংঘাত চলছে। সেই তুলনায় আমরা স্বাধীন। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু মুসলমান কমেনি। কেন হিন্দুদের আক্রমণ করা হয়? তাকে বিতাড়িত করতে পারলে তার বাড়ি দখল করা যায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা যায়, সেখানে আসন গেড়ে বসা যায়। ফলে ঘরের শত্রুদের চিহ্নিত করতে না পারলে আমরা বাইরের শত্রুদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েও পার পাব না। এই সংকট থেকে বেরুতে গেলে মুক্তবুদ্ধির, বিবেকবান মানুষের কথা শুনতে হবে। সেভাবে কাজ করতে হবে। রনেশ মৈত্র’র লেখায় আছে, তার গ্রামের গান্ধী আশ্রম সাম্প্রদায়িকতার সুযোগে দখল হয়ে গেল। নাম বদলও হয়েছে। আমরা তো জানি, ১৯৭৫ সালের পরের বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির একটি অংশ আওয়ামী লীগের। ফলে আমাদের এই থেকে উত্তরণ করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পূরণ করতে চাইলে আগে নিজেকেই তো অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। ২০০১ সালের কমিশনের সুপারিশও তো বাস্তবায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পার্থক্য আমরা কিভাবে করবো? যেখানে তাদের দুই দলের প্রধানের প্রিয়তম স্বজন মারা গিয়েছেন হত্যাকাণ্ডে অসহায়ত্ব, নিরাপত্তাহীনতা কী আমরা লুপ্ত করতে পেরেছি? গণতন্ত্র ছাড়া, মানুষের ভালোবাসা ছাড়া অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কোনোদিনও হবে না। আজকে তো আওয়ামী লীগের মুখে সমাজতন্ত্রের কথা শোনাও যায় না।”
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেছেন, “আমি সেই দিনের সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের দেশের আজকের এখানের শ্রোতারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। আপনারা কিছু জানেন, কিছু উপলব্ধি করেন, বাকিটা বোঝার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই জাতিকে উদ্বুদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমাদের সবার অঙ্গীকার ছিল ধমনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ আনবো। তাকে গড়ে তুলব-এই ছিল জীবনের স্বপ্ন। বাঙালি জাতির আশা, আকাংখা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের কেন্দ্রে ছিল। আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি এই দেশের জন্য। বঙ্গবন্ধু অনন্য। তিনি উপস্থিত যে ভাষণ দিতেন, সেগুলো সরল কথার। তার ওপর অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেসব থেকেও আমরা মহৎ মানুষটিকে জানতে এবং বুঝতে পারি। বাংলাদেশের সংবিধান তার পৌরহিত্যে হয়েছে। তবে তার মৃত্যুর ৪৭ বছরের মধ্যে আমাদের মূল রাষ্ট্রীয় চারটি আদশের গায়ে জখম আছে। ফলে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তাদের অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। আমাদের সমাজ মানস, জনগনের মধ্যে কেন সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক পৃষ্ঠপোষকতা নেই কিন্তু দোদুল্যমানতা, আপসকামীতা আছে। অথচ এই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটি ১৯৫৫ সালে তাদের দল থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়েছিল। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে একজন সামরিক শাসক ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধম করেছেন। তিনি সংবিধানে যুক্ত করেছেন ফরমান বলে। আবার তারই রাসূল (সা:) মদীনাতে মানুষের অধিকারের চচা করেছেন। প্রকৃত ইসলাম গণতান্ত্রিক। এই দেশেই কী না বাংলা ভাষার জন্য আমাদের জীবন দিতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। নারীর অধিকারের জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেয়াদের ভিসি এবং গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কৃতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, “যারা সেদিন ঘাতকের বুলেটে শহীদ হলেন আমি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। আমি তাদের স্মরণ করছি, তাদের জন্য শপথ করছি। যেকোনো কাজের পরিকল্পনা করতে হয়, সে অনুসারে কাজ করতে হয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে বলেছেন, ‘কখন কী করতে হবে, আমি বলব।’ ১ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার হোটেল পূর্বাণীর জলসাঘরে আওয়ামী লীগের পালামেন্টারি বোর্ডের পূব নির্ধারিত সভা বাতিল হয়ে গেল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান দলটি আর সংসদে যাবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধে নামলেন। ২ মার্চ ঢাকায় আমরা সবাই হরতাল করলাম, ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল হলো, ৭ মার্চ রেসকোর্সে এলেন শেখ সাহেব। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, তার স্বাধীন, স্বপ্নের বাংলাদেশে এসে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুরু করলেন। তাকে সেটি শেষ করতে দেওয়া হলো না। তাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হলো। এ কাম্য নয়। আমাদের এই প্রজাতন্ত্রের মালিক কিন্তু জনগণ। আমাদের সংবিধানেও আছে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছেন। তার মেয়ে সবাইকে বিনা পয়সার অত্যন্ত ভালো বই পড়তে দেন। ফলে আগামীর ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়। পাঠ্যক্রমের বাইরে আমাদের শিক্ষকদের সবসময় কিছু কথা বলার থাকে। স্কুল, কলেজে কী আমরা বলি? ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব নাগরিক গড়তে হয়। আবার এই দেশেই ড. ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’র ২৫০টি সুপারিশের ৫০টিও আমরা কোনো অধ্যাপক বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কেন? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি এবার, ‘বিদ্যা সহজ কিন্তু শিক্ষা কঠিন।’ তিনিই বলেছেন, ‘বিদ্যা আবরণ, শিক্ষা আচরণ।’ আমাদের ভেতরের শিক্ষা কতটুকু হয়েছে? দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলা স্কুল চালু করেছেন। আমাকে ভার্চুয়ালি দাওয়াত করেছেন। বলেছি, ‘আপনারা বাংলা ভাষার বিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেশের প্রতি আরো ভালোবাসার জন্ম দিয়েছেন।’ এই দেশে বঙ্গবন্ধু ও অন্যরা বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছেন। তবে তারপরও আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করে যেতে হবে। আমাদের সবাইকে সকল নাগরিককে সমানভাবে দেখতে হবে। আমরা এই শিক্ষা শ্রেণীকক্ষে দেই। আমি বলবো, ‘ছাত্র, ছাত্রীদের সবসময় সুশিক্ষা দিতে হবে, সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। আমরা আমাদের জীবনে কী করছি, তা দেখেও যে তারা শেখে’।”
নাট্যাভিনেতা ও পরিচালক এবং থিয়েটার নাট্যপত্রিকার সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অল্প দিনের জীবন। তিনি মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছেন। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। যে আকাংখা আমাদের হাজার বছরের সংগ্রামের ফসল। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন, মুসলিম লীগ করেছেন। তারপরও এখনো আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আন্দোলন কেন করতে হচ্ছে? তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতেন। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় ট্রেন থামিয়ে বেছে বেছে হিন্দুদের মারা হয়েছে। আমার শিক্ষক অজিত কুমার গুহের বাসায় ফোন করলাম। এরপর তিনি আমার বড় ভাইয়ের বাসা তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে এসে তার গাড়িতে আমাদের ৩২ নম্বর নিয়ে বাঁচালেন। এরপর সন্ধ্যায় শহীদ অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আমাদের নিয়ে গেলেন। তিনি আমার স্ত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের আপন বড় ভাই ছিলেন। এখনো কেন হিন্দুর ওপর আক্রমণ হলে মুসলমান প্রতিবেশীরা সাহায্য করতে আসেন না? মানুষ কেন মানুষের পাশে দেশে, দেশে থাকেন না? এই দেশে মানুষটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছেন। আমাদের রাষ্ট্র এখন পরিচালনা করছেন ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সরকার। কিন্তু সমাজ তো চলে গিয়েছে ধমের হাতে, ধমীয় লেখাপড়ার ভুবনে। ফলে এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভালোভাবে ঐক্যমত হতে হবে। তারা ধর্ম ও জীবন নিয়ে আর রাজনীতি করতে পারবেন না। শিক্ষা ও পরিবারে এই চর্চা থাকতে হবে। অন্য ধর্মের প্রতি, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। ভালো সংস্কৃতির চচা করতে হবে। যাত্রা করতে গেলে আইন, শৃংখলা কেন বিঘ্নিত হতে পারে? সেসব বন্ধ করে কেন দেওয়া হয়? আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে, সীমিত পরিসরে হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তাহলে নিজে, দেশ ও মানুষ বাঁচবেন। এখনো সময় আছে।”
বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম.এ. মান্নান বলেছেন, “আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বলে সবাইকে কম-বেশি আক্রান্ত হতে হচ্ছে। তবে পিছপা হলে হবে না। তবে আমি সুবিধার কাছে আছি। এই বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে না। আমাদের নিজেদের চেতনার কাছে আশ্রয় নিতে হবে সব কাজে। আমরা তো ১৯৪৭ সাল থেকে সমন্বয় ও সংগ্রামের সুফলেই এসেছি। ভালোবাসায় পথ চলেছি। আমি নিজে উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ছিলাম। ফলে আগেই ‘হালুয়া-রুটি’ খেয়ে এসেছি। আমার আর প্রয়োজন নেই। শেষ ভরসা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তার ওপর আস্থা আছে। আমাদেরকেও সুযোগ দেওয়ার দরকার আছে। প্রগতির দিকেই আমরা সবাই যাব। সামান্য যে নিভু, নিভু তেল তা দিয়ে ভালোবাসা যায়, আয়ত্ব করা কঠিন। ফলে আমি কঠিন দিকেই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আমরা সামনে যাব, পিছপা হব না।"
শেখর দত্ত বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর। তিনি এই অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মানবতা ও মানবিকতা, জীবনের জয়গানের স্বাক্ষী। এখন তো মানবতা ধ্বসে পড়েছে। দুনিয়া ধ্বংসের মধ্যে আছে। দীর্ঘদিন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল, তারা এখন দেশ গড়ছেন। তারপরও কেন দলের মধ্যে দল? যত দল, তত বিপদ। ফলে সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবতাবাদী দলকে একত্র হতে হবে। এক হতে হবে। কেননা, আমাদের উৎসব যার, যার; ধর্ম সবার। রক্তেরও শক্তি আছে। সে হলো কমিটমেন্ট টু দি পিপল। আর গণতন্ত্রের মূল কথা হলো জবাবদিহিতা। সেজন্য সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এই দেশের জাতীয়তাবাদ যেদিন শেষ হয়ে যাবে সেদিন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে। আমাদেরকে দলাদলি বাদ দিতে হবে। আমরা জাতীয় চার নীতিও বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখি।’
এরপর আপ্যায়ন ও সমাপ্তি।