ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩২
বিষাদ বসুধা
শাহবাজ খান ঘুমের ঘোরে মোহিনীকে ডাকছেন। নীলিমা খান অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই নাম শুনে তার শরীরে কাঁপন ধরেছে। বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়েছে। মাথাটা উথালপাথাল ঘুরছে। আতঙ্ক আর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, এ কী সর্বনাশা কাণ্ড! মোহিনী! এ নাম তো আগে কখনো শুনিনি! তার বান্ধবীর তালিকায় আরেকটি নাম নতুন যুক্ত হলো! নাকি মোহিনীর প্রেমে সে দেওয়ানা! ঘুমের ঘোরে কখন মানুষ কারও নাম ধরে ডাকে?
নীলিমা খান উৎকট মদের গন্ধ টের পান। শাহবাজ খান যে রাতভর মদ গিলেছে সেই কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তিনি জানেন, শাহবাজ খানের পেটে মদ পড়লেই মনের কথা সব বেরিয়ে যায়। মোহিনীর সঙ্গে নিশ্চয়ই তার কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে। অথবা নতুন তৈরি হয়েছে। তা না হলে এই নাম বলার কথা না। মোহিনার নাম শোনার পরই তার মাথায় আগুন ধরে যায়। তিনি শাহবাজ খানের কাছে এগিয়ে যান। তাকে ডাকেন। এই! শাহবাজ! কী হয়েছে তোমার?
শাহবাজ খান এদিক সেদিক মোড়ামুড়ি দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। নীলিমা শাহবাজ খানের মোবাইল হাতে নিয়ে কললিস্ট দেখেন। কললিস্টে মোহিনীর নাম দেখে তার মেজাজটা আরও বিগড়ে যায়। তিনি নম্বরটা নিজের মোবাইলে সেভ করেন। তারপর বিছানা ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসেন। রাজ্যের ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। মোহিনী কে? কী করে সে? সে কি কোনো মডেল? নাটক-সিনেমা করে? নাকি অন্য কিছু...? নীলিমা মনে মনে এও ভাবেন, শাহবাজ খান কিছুতেই মোহিনীর কথা স্বীকার করবে না। সে যে তার নাম ধরে ডেকেছে এটাকে বলবে, আমার বানানো গল্প। ইস! আমি যদি রেকর্ড করে রাখতাম! এত দ্রুত কি আর রেকর্ড করা সম্ভব! মোহিনী নামটা আগে কখনো আমি শুনিনি। এটা যে নতুন জুটেছে সেটা আমি নিশ্চিত। ঘুম ভাঙার পর তাকে ধরতে হবে। মোহিনী কে তা তাকে বলতে হবে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই নীলিমা কেঁদে ওঠেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারেন না। কাজের লোকগুলো বাইরে থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কৌতূহলের বসে দরজা নক করে। নীলিমা ধমকের সুরে বলেন, এই কে! মুহূর্তের মধ্যে সবাই চলে যায়। তারা যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নীলিমা বসে থাকেন। তার মাথায় হাজারো ভাবনা ঘুরপাক খায়। তিনি নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢোকেন। শাহবাজ খানের ফ্রেন্ডলিস্ট দেখেন। পাঁচহাজার বন্ধু তালিকায় মোহিনী নাম নেই। তার ফলোয়ারের সংখ্যা দুই লাখ। নিশ্চয়ই ফলোয়ার তালিকায় থাকবে। নীলিমা এবার নিজের ফেসবুকে মোহিনী নাম সার্চ দেন। বেশ কিছু নাম তার মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কেউ ছাত্রী। কেউ চাকরিজীবী। কেউ গৃহিণী। চেহারা দেখে একটাও তার পছন্দ হয় না। তার মনেই হয় না, এর মধ্যে কেউ শাহবাজ খানের বান্ধবী হবে। তারপরও তিনি মনে মনে বলেন, পুরুষ মানুষকে ভিমরতিতে পেলে কাজের লোকের সঙ্গেও শুতে পারে। সে তুলনায় এগুলো তো ভালোই!
নীলিমার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। সংসার শুরুর সময়ও সে এ রকম ঝামেলায় পড়েছিল। প্রতিরাতে মদ খেয়ে শাহবাজ খান একেক জনের নাম ধরে ডাকত! কী যে ভয়ঙ্কর ছিল সেই সময়গুলো! তার অসংখ্য বান্ধবী। এদের কেউ না কেউ তার বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হতো। এ নিয়ে কত ঝগড়াঝাটি, কান্নাকাটি করেছে! কোনো কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে নালিশ করল। তারপর কিছুদিন বন্ধ ছিল। ইদানিং আবার বান্ধবীদের নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু হয়েছে।
নীলিমা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে। সে যদি তার অভ্যাস পরিবর্তন করতে না পারে তাহলে আমি আর থাকব না। অথবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করব। তার আগে বিষয়টা কি শ্বশুর-শাশুড়িকে জানাব? বার বার সে একই কাণ্ড করবে; আর আমি শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে নালিশ করবে! এই করে কতদিন! আমি বরং তাকেই জিজ্ঞাসা করি। সে আসলে কী চায়? কেন সে আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করছে? সে কি ভাবছে, আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই! সেটা যদি ভেবে থাকে তাহলে সে আমাকে ভুল চিনেছে। আমি ছেলে মেয়ে দেখব না। নিজের জীবনই যদি বিপন্ন হয় তাহলে ওসব দিয়ে কী হবে!
নীলিমা আবার কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে দুই চোখ ফুলে যায়। তিনি বাথরুমে দাঁত ব্রাশ করেন। চোখে পানির ঝাপটা দেন। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। মনকেও শক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। দেখ নীলিমা; তোমাকে অনেক বেশি শক্ত হতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমার বাবা অনেক সম্পদ তোমার জন্য রেখে গেছেন। তুমি যদি চলেও যাও তাহলে তোমার কোনো সমস্যা হবে না। ইচ্ছা করলে তোমার দুই প্রজন্ম শুয়ে বসে খেতে পারবে। এত কী ভাবছ! তুমি শাহবাজের মুখোমুখি দাঁড়াও। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাও। দেখ কি জবাব দেয়। তুমি যদি তার জবাবে সন্তুষ্ট না হও তখন সরাসরি তাকে বলবে। কঠিনভাবে বলবে। দেখ শাহবাজ, তুমি যদি তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে না পারো তাহলে কিন্তু আমি আর থাকব না। আমাকে তুমি হারাবে।
নীলিমা আবার ঘরে আসেন। সোফায় হেলান দিয়ে বসেন। শাহবাজ খানের জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার ঘুম থেকে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। সম্ভবত আরও কয়েক ঘণ্টা সে ঘুমাবে। সারাদিন ঘুম থেকে নাও উঠতে পারে। নীলিমা আর অপেক্ষা না করে বাইরে বের হন। বাচ্চাদের খোঁজখবর নেন। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে নাশতার টেবিলে যান। অনেকদিন পর নীলিমা আবার শাহবাজ খানের মুখোমুখি হন। তার কাছে তিনি জানতে চান, তুমি আমাকে সত্যি করে বলো, হু ইজ মোহিনী? একটুও মিথ্যা বলবে না।
মোহিনী? কেন, কী হয়েছে?
আমি যা জানতে চেয়েছি তার জবাব দাও।
আচ্ছা, হঠাৎ মোহিনীকে নিয়ে তুমি এত উত্তেজিত কেন?
কারণ নিশ্চয়ই আছে। তুমি বলো কে সে?
আমার একটা ফ্রেন্ড। একসঙ্গে পড়েছি।
তাই! কই আগে তো কখনো বলোনি!
বলিনি প্রসঙ্গ আসেনি।
দুয়েক দিনের মধ্যে তার সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?
না।
কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
আর তাতেই সারাক্ষণ তার নাম জপছো!
মানে!
ভোরে ঘুমের ঘোরে মোহিনী মোহিনী বলে ডাকাডাকি করেছ। কেন করেছ?
বোগাস কথা বলার আর জায়গা পাও না!
মোটেই না। আমি তাহলে মোহিনীর নাম কি করে জানলাম?
সেটা আমি কী করে জানব?
দেখ, এসব বাদ দাও। আর যদি বাদ দিতে না পারো সেটাও আমাকে খোলাখুলি বলো।
কী বাদ দেব? আমার বন্ধুবান্ধব?
না। তোমার বান্ধবীদের বাদ দেবে।
আচ্ছা, কিছু দিন পর পর তোমার কী হয়? এমন কেন করো তুমি?
তুমি করাও বলেই তো করি! তুমি আমার পাশে শুয়ে আরেক নারীর নাম জপবে; আর আমি তা সহ্য করব? মোটেই না। কিছুতেই না।
আমার মনে হয় তোমার মানসিক সমস্যা আছে।
মানসিক সমস্যা যদি হয়েই থাকে সেটা তোমার কারণে।
বাজে কথা রাখো তো!
কোনটা বাজে কথা?
তুমি যা বলছ।
সত্য কথাগুলো সব বাজে কথা; তাই না?
নীলিমার কথায় শাহবাজ খানের মেজাজ চড়ে যায়। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।
নীলিমা ক্রোধের দৃষ্টিতে শাহবাজ খানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, বাড়াবাড়ি আমি করছি না তুমি করছ?
আবার কথা বলো! ভালো না লাগলে তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারো। আমার ঝগড়াঝাটি ভালো লাগে না।
ঠিক আছে। আমার সিদ্ধান্ত আমিই নেব।
কথা শেষ করে নীলিমা হনহন করে চলে গেলেন। বিরক্তি আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে শাহবাজ খান তার চলে যাওয়া দেখলেন।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এমএমএ/