ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৬
বিষাদ বসুধা
আরেফিন অন্যভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বললেন, আমার ক্যারিয়ারের জন্য খুব প্রয়োজন। যেতে রাজি না হলে আমার চাকরির জন্য সমস্যা হতো।
মোহিনী রেগেমেগে বললেন, রাখো তোমার ক্যারিয়ার! তোমার সংসার বড়ো নাকি তোমার চাকরি?
আরেফিন নরম গলায় বললেন, দুটোই বড়। তুমি এতোটা রাগবে তা আমি বুঝতে পারিনি মোহিনী। তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আমি আসলে আমার ক্যারিয়ারের কথা ভেবেছি। আর আমার চাকরির সমস্যা হবে বলেই এটা করেছি।
তাহলে আমার সঙ্গে আগে থেকে আলোচনা করতে! আমাকে জানাতে যে, এ রকম একটা অফার তুমি পেয়েছ! এটা তো হুট করে আসেনি; তাই না? জাতিসংঘ একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা তো আর হুট করে বলবে না। সময় দেবে।
আসলে তোমাকে জানাব জানাব করে আর জানানো হয়নি। আমার ভুল হয়ে গেছে মোহিনী। প্লিজ তুমি এবারের জন্য বিবেচনা করো। আমার আর এ রকম হবে না।
না। আমি এটা কিছুতেই মানব না। তুমি গেলে নিজ দায়িত্বে যাবে।
মোহিনী!
হ্যাঁ। তুমি গেলে নিজ দায়িত্বে যাবে। আমি অনেক সহ্য করেছি। আর না।
মোহিনীর কথা শুনে আরেফিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। শেষ মুহূর্তে না গেলে ওর চাকরি থাকবে না। এসময় চাকরি গেলে চাকরি পাওয়া যাবে না। আরেফিন অসহায় হয়ে পড়বেন। তিনি যে প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠান তাও বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ হলে সবাই না খেয়ে মরবে। এটা ভাবতেই তার গা শিউরে ওঠে।
আরেফিন চোখ বন্ধ করে পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে সে আর ভাবতে পারেন না। তিনি মোহিনীকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মোহিনী তার কোনো কথাই কানে তুলছেন না। এ বিষয়টি নিয়ে সে কোনো আলোচনাই করতে রাজি নন। সঙ্গত কারণেই আরেফিন আর আগান না। তিনি চোখে চোখে তার অসহায় মা বাবাকে দেখেন। তার অসহায় ভাইবোনকে দেখেন। আরেফিনের টাকায় যাদের অন্ন জোটে। তিনি মনে মনে ভাবেন, এই অসহায় মানুষগুলোর কি হবে? আমি কি মোহিনীর কাছে হাত পাতবো? সে অনেক দিয়েছে। যথেষ্টই দিয়েছে! তার কাছ থেকেই বা কত চাইব? না না! এ হয় না। নিজের চাকরি না থাকলে মানুষের কোনো ব্যক্তিত্ব থাকে না। পরমুখাপেক্ষি মানুষ ভিক্ষুকের চেয়েও অধম। মোহিনী আমার বউ; তাতেে কি? তার যত টাকাই থাকুক, আমার না থাকলে সে বেশি বেশি খোটা দেবে। অন্যের টাকার ওপর ভরসা করে মা বাবাকে টাকা পাঠাবো?
আরেফিন আবার ভাবে, মোহিনী খুব ভালো মেয়ে। আমি অনেক ভুল করেছি। মোহিনীকে অবহেলা করেছি। সে সেগুলো মনে রাখেনি। তার মেজাজ ঠাÐা হলে সব ভুলে যাবে। সে আমাকে ঠিকই যেতে দেবে। আমি যদি ভালো কিছু করি তাহলে নিশ্চয়ই সে খুশি হবে।
এরমধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আরেফিনের বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গটিও চাপা পড়ে যায়। হঠাৎ একদিন আরেফিন মোহিনীকে বললেন, সাতাশ ডিসেম্বর তিনি চীন যাবেন। বিকেলে তার ফ্লাইট।
একথা শুনে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকান মোহিনী। তিনি মনে মনে শুধু বললেন, এতোকিছুর পরও আরেফিন বিদেশে যাচ্ছে!
মোহিনী নিজেই আরেফিনকে বিমান বন্দর পৌছে দিতে যান। স্বাভাবিকভাবেই আরেফিনকে বিদায় দেন। মোহিনী তাকে বুঝতে দেননি যে, তিনি নিজেদের বাসায় ফিরে আসবেন। তিনি শুধু বিদায়ের সময় আরেফিনকে উদ্দেশ করে বললেন, ভালো থেকো। আর কোনো কথা হয়নি তাদের মধ্যে।
ইমিগ্রেশন পার হয়ে আরেফিন ফোন দিয়েছিলেন। একবার দুবার নয়, পাঁচ পাঁচবার। কিন্তু মোহিনী ফোন ধরেননি। পরে একাধিকবার আরেফিন মোহিনীকে এসএমএস করেছেন। তারও কোনো জবাব দেননি তিনি। ইচ্ছা করেই এটা তিনি করেছেন। এবার মোহিনী তাকে বুঝিয়েছেন, তার বিদেশ যাওয়া তিনি ভালোভাবে নেননি। ফোন না ধরার কারণে আরেফিন চিন্তায় পড়েছেন। কেন ফোন ধরছে না, কেন এসএমএসের কোনো জবাব দিচ্ছে না তা নিয়ে আরেফিনের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
আরেফিন ড্রাইভারকে ফোন দেন। সেও ফোন ধরছে না। পরে আরো কয়েকবার তাকে ফোন দেয়া হয়েছে। কিন্তু আরেফিন ফোন ধরেনি। এতে আরেফিনের দুশ্চিন্তা আরো বাড়ে। তিনি মনে মনে বলেন, কি ব্যাপার! ড্রাইভারও তো ফোন ধরছে না! কি ঘটনা?
আরেফিন এবার তার বন্ধু সওগাত আলীকে ফোন করেন। তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তিনি তাকে অনুরোধ জানান, মোহিনীকে ফোন করে বিষয়টা বোঝার জন্য। সওগাতের ফোন ধরলে আরেফিন বুঝতে পারবেন।
আরেফিনের অনুরোধে সওগাত মোহিনীকে ফোন করেন। সঙ্গে সঙ্গে মোহিনী তার ফোন ধরেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। সওগাত আরেফিনের কথা জানতে চায়। তিনি তার জবাবও ঠিকঠাক মতো দেন। পরে সওগাত আরেফিনকে ফোন করে বললেন, মোহিনীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলে তো নেগেটিভ কিছু মনে হলো না। স্বাভাবিক মনে হলো।
আরেফিন সওগাতের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ফ্লাইট ধরার জন্য এগিয়ে যায়। যেতে যেতে তিনি ভাবেন মোহিনীকে নিয়ে। তিনি মনে মনে বলেন, মোহিনী সওগাতের ফোন ধরল! অথচ আমার ফোন কেন ধরছে না!
আনোয়ারা বেগম মোহিনীকে দেখে চমকে উঠলেন। মোহিনী এ সময় তাদের বাসায় যাবেন তা তিনি কল্পনাও করেননি। বিয়ের পর শুক্রবার কিংবা শনিবার ছাড়া তিনি তাদের বাসায় যাননি। ঈদের সময় দুটি ঈদ তিনি বাপের বাসায় করেছেন। আর দুটি ঈদ করেছেন দেশের বাইরে। ওদের বিয়ের বয়স চার বছর। মোহিনী তার সংসার এবং নিজের অফিস নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তবে প্রতিদিন তার মা’র সঙ্গে কথা বলা তার অভ্যাস। সেটাও দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সেই সময়টা আনোয়ারা বেগম জানেন। অন্য সময় আনোয়ার বেগমও ফোন করলে বলেন, মা আমি এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলি!
মা মেয়ের সম্পর্কটা খুবই চমৎকার। কিন্তু সময় বুঝে তারা কথা বলেন। আনোয়ারা বেগম জানেন, তার মেয়ে একটা অফিস চালায়। তাকে তার অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সেই ব্যস্ততার মাঝে আনোয়ার বেগম কখনোই মেয়েকে ফোন করেন না। বিশেষ প্রয়োজন হলে এসএমএস করে ফ্রি আছে কি না জানতে চান। তারপর ফোন করে কথা বলেন। বিয়ের পরও এই রুটিনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি জানেন মেয়ের নিজের সংসার হয়েছে। সে তার অফিসের কাজের বাইরে স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেই সময়ে তিনি ভাগ বসাতে চান না।
আনোয়ার বেগম বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চান, মোহিনী তুই!
কেন মা? তোমাদের বাসায় বুঝি আমার আসতে মানা?
আরে কি বলিস তুই? আমাদের বাসায় মানে! এটা তোরও তো বাসা! আর আসতে মানা হবে কেন? বিয়ের পর তোকে এরকম অসময়ে তো দেখিনি!
তোমাকে দেখতে এলাম মা।
মেয়ের কথা শুনে হাসি ছড়িয়ে দিলেন তিনি। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই আসবি না তো কে আসবে বল! কেমন আছিস মা?
মোহিনী স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ভালো আছি মা।
তুই একা! আরেফিন কোথায়?
ও চীনে গেছে। উহানে ওদের দুই মাসের কর্মশালা আছে।
দুই মাস! বলিস কী! এতোদিন কিসের কর্মশালা?
কি জানি। জানি না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার বাসায় আপাতত যাচ্ছি না। তোমাদের এখানেই থাকব।
বিস্ময়ের সঙ্গে আনোয়ারা বেগম বললেন, মানে! হ্যারে মা, তোরা ঝগড়াঝাটি করিসনি তো?
না মা। তেমন কিছু না। তবে আমি আপাতত তোমাদের এখানেই থাকব।
আনোয়ারা বেগম চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি মেয়ের পাশে গিয়ে বসেন। বোঝার চেষ্টা করেন। আরেফিনের সঙ্গে সত্যিই কিছু হয়েছে কিনা তা বুঝতে চান তিনি। বিয়ের সময়ই তিনি আপত্তি করেছিলেন। মোহিনীর বাবাও চাননি আরেফিনের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। মোহিনী জোর করে তাদেরকে রাজি করিয়েছেন। তিনি তার মা বাবাকে বলেছেন, তোমরা আমাকে নীতি নৈতিকতা শিখিয়েছ। মানবিকতা শিখিয়েছ। মনুষ্যত্ববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ আমার ভেতরে ঢুকিয়েছ। আমি তার বাইরে যাই কি করে বলো! আমি আরেফিনের পরিবার দেখিনি। ওর কি আছে না আছে সেদিকে নজর দিই না। আমার প্রতি আমার যে অন্ধ ভালোবাসা; তাও নয়। আমি শুধু কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।
মোহিনীকে কিছুতেই বোঝানো যায়নি যে, অশিক্ষিত, নীচু পরিবার থেকে উঠে আসা কোনো ছেলে মেয়ে, যতই শিক্ষিত হোক, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পাল্টাবে না। মানসিকতা পাল্টাতে পারবে না। কথায় বলে না, গোবরে পদ্ম ফুল। মেধার গুণে গোবরে পদ্মফুল ফুটতেই পারে। কিন্তু তার মানসিকতা পদ্মফুলের মতো হবে না।
মোহিনী দাম্পত্য জীবনের দূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে হারে হারে উপলব্ধি করছেন যে, তিনি কতবড় ভুল করেছেন! দাম্পত্য জীবনের জটিল অংক মেলাতে গিয়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুন্দরভাগে এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ যেন থমকে গেছে। মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছে। কখনো কখনো মানসিক চাপ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেই চাপ তিনি আর নিতে পারছেন না।
মোহিনী তার মা’র কাছে অকপটে তার ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন ভুল তিনি করেছে যা শোধরাবার নয়। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে। জীবনকে তিনি থমকে দিতে রাজি নন। জীবন চলমান নদীর মতো। নদী যেমন সব ধরনের ঝড়ঝঞ্জা মারিয়ে এগিয়ে চলে, মোহিনীও তেমনি করে এগিয়ে চলতে চান। তিনি তার ব্যবসার হালটাকে শক্তভাবে ধরতে চান।
মোহিনীর কথায় আনোয়ারা বেগম ভীষণভাবে আপ্লুত হন। তিনি মনে মনে বলেন, এই না হলে আমাদের মেয়ে!
আনোয়ারা বেগম চুপ করে আছেন দেখে মোহিনী বলেন, মা তুমি চুপ করে আছো যে! কিছু বলছ না যে! আমি থাকলে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে? অসুবিধাবোধ করলে আমি চলে যাবো।
মোহিনী, তুই এমনভাবে বললে আমি খুব কষ্ট লাগে। তুই আমার একমাত্র মেয়ে। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে? আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা এতো সম্পদ দিয়েছেন, এসব কে খাবে? কে দেখবে? তোকেই তো সব দেখতে হবে!
ধন্যবাদ মা। আমি এখন অফিসে যাবো। আমার রুমটা ঠিকঠাক করিয়ে রেখো।
ঠিক আছে। তুই অফিসে যা।
চলবে....
আরও পড়ুন