ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব- ৩১
বিষাদ বসুধা
করোনার কারণে এবার ঈদ কাটল নিরানন্দে। এ রকম ঈদ মুসলমানদের জীবনে বিগত একশ’ বছরেও আসেনি। মক্কার পবিত্র কাবা শরিফ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌদি সরকার সাতাশ ফেব্রুয়ারি (দুই হাজার বিশ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে হজ ও ওমরাহ ভিসা স্থগিত করে দিয়েছে। এমনকি পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে তাওয়াফও স্থগিত করা হয়।
ইতিহাসে আছে, নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার পর থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা, মহামারির প্রাদুর্ভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেকবার হজ ও ওমরাহ বন্ধ ছিল। সেটা হাজার বছর আগের কথা। সাধারণত কাবা শরিফ কখনো বন্ধ থাকে না। দিবারাত্র চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। সারাবিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সেখানে যান। সারাক্ষণই তারা জিকির আসকার করেন। নামাজ আদায় করেন। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে পানাহ চান। এবারই তার ব্যত্যয় ঘটল। করোনায় কাবা শরিফের দরজাও বন্ধ করে দিতে হল।
বাংলাদেশে অবশ্য বিধিনিষেধ মেনে সীমিত আকারে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য মুসল্লিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। খুব কম সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে খুব সতর্কতা ঢাকা শহরের মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত হয়েছে। আসিফ আহমেদের বাসা মসজিদ লাগোয়া। বাসা থেকে মাইকে ইমামের বক্তৃতা, নামাজের একামত সবই শোনা যায়। তাই তিনি মসজিদে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেন না। তিনি ঘরে বসেই ঈদের নামাজ আদায় করলেন। বাসাতেই ঈদের ছুটি কাটালেন। প্রতিবার কোরবানির ঈদে তার বাসায় ভাইবোনরা ও তাদের ছেলেমেয়েরা আসে। ভীষণ আনন্দ হয়। এবার কেউ আসেনি। তিনিও কারো বাসায় যাননি। টানা চারদিন বাসায় শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন।
ঈদের একদিন পরই অফিস খুলে যায়। আসিফ আহমেদ সকাল সকাল অফিসে যান। তার মতে, অফিসের শীর্ষ ব্যক্তি সময়মতো অফিসে না গেলে অন্যরা গাফিলতি করে। তাই তিনি কোনো অবস্থাতেই অফিসে দেরি করেন না। করোনায় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন অফিস করেন। যদিও অফিসের অনেকের জন্য ‘হোম অফিস’ চালু করেছেন। যাতে পুরো টিম আক্রান্ত হয়ে না যায় সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
আসিফ আহমেদ গাড়ি থেকে অফিসের গেটে নামার পর দেখে সেনিটাইজার কিংবা নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ নেই। দুএকজন পিওন দাঁড়িয়ে আছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অফিস ঝাড়াপোছা করছে ঠিকই। কিন্তু তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তারা হেলেদুলে চলছে। কাজে ভালোভাবে হাত লাগাতে পারছে না।
চারদিন ছুটি কাটানোর পর সবার মধ্যেই এক ধরনের আলসেমি ভাব থাকে। যাই যাচ্ছি করে অফিসে যেতে দেরি করে। কিন্তু পত্রিকা অফিসে যাই যাচ্ছি করলে চলে না। বলতে হয় এখনই যাচ্ছি। পত্রিকার অনলাইন খোলা ছিল। এই শাখার সংবাদকর্মীরা ঈদের দিনও অফিসে এসে কাজ করেছে। ওরা নিজেদের বাসা থেকে খাবার এনে খেয়েছে।
আসিফ আহমেদ অফিসে এসেই অনলাইন শাখার কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাদের খোঁজখবর নেন। তারপর নিজের দপ্তরে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলে ফোন আসে। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, এমডি সাহেব ফোন দিয়েছেন। ফোন ধরে সালাম জানিয়ে আসিফ আহমেদ তাকে ঈদ মোবারক জানান। শাহবাজ খান ঈদ মোবারক জানিয়েই বললেন, আগামী রবিবার আপনার সঙ্গে মিটিং। সকাল এগারোটার মধ্যে চলে আসবেন। দেরি করবেন না। তালিকাটা নিয়ে আসবেন।
শাহবাজ খান আর কোনো কথা বললেন না। তিনি হঠাৎ করেই ফোন রেখে দিলেন। আসিফ আহমেদ ভাবনায় পড়ে যান। আবার সেই তালিকা! ছাঁটাই না করে তিনি শান্তি পাচ্ছেন না! কে তার মাথায় এটা ঢোকাল? হিসাব বিভাগ? ওদের তো কাজ একটাই। আয় কমেছে কাজেই লোক কমাও। এটাকে যে অন্যভাবে ম্যানেজ করা যায় সেটা ভাবে না। মিডিয়াবান্ধব হিসাবরক্ষক না হলে যা হয়! শুধু কস্ট-কাটিংয়ের কথা মাথায় রাখে। আর কিছু চিন্তা করে না। একটা বড় পত্রিকা। পত্রিকা ভালো না হলে পাঠকরা ছুড়ে ফেলবে। আর একবার ছুড়ে ফেললে সেটা আর হাতে তুলবে না। ডাসবিনে যেমন মানুষ কাগজ ছুড়ে ফেলে তেমনি পত্রিকাটাও ছুড়ে ফেলবে। এটা মালিক কর্তৃপক্ষও ভালো করেই জানে। জানে না হিসাব বিভাগ। ওরা চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য সারাক্ষণ কস্ট-কাটিংয়ের হিসাব কষে।
হিসাবরক্ষকদের হিসাবের গ্যাড়াকলে পড়েছি আমরা। এর আগে কস্ট-কাটিং করতে গিয়ে পত্রিকার সার্কুলেশনই কমিয়ে দিয়েছে। প্রায় এক লক্ষ কাগজ কমিয়ে দিয়েছে। এখন চেষ্টা করেও আর সার্কুলেশন বাড়ানো যাচ্ছে না। পত্রিকা হচ্ছে স্ত্রীলোকের মতো। একবার ঘর থেকে বের হয়ে গেলে মানুষ তাকে আর ঘরে তুলতে চায় না। সবাই চায় সার্কুলেশন বাড়াতে। আর এরা হিসাবরক্ষকদের কথায় সার্কুলেশন কমিয়ে এখন হায় হায় করছে। তারপরও সার্কুলেশনের লোকরাই এদের কাছে প্রিয়।
এ এক অদ্ভুত ধরনের অফিস। হিসাবরক্ষকদের কথা ছাড়া এরা এক চুলও নড়ে না। এরা এত বড় কীভাবে হলো তা আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন। সবাই দেখল, হিসাবরক্ষকের কথায় পত্রিকার সার্কুলেশন কমিয়ে কতবড় ক্ষতি হয়েছে! অথচ সেই লোকটি বহাল তবিয়তে আছে! তার সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। পদোন্নতি হয়েছে। অথচ দশ বছরেও অনেক সাংবাদিকের কোনো পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতির কথা বলতে গেলেই সোরগোল ওঠে, খরচ বেড়ে যাবে। কিছুতেই এটা করা যাবে না। পদোন্নতিই যদি না হয় তাহলে কিসের আশায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা ছেলে এখানে বছরের পর বছর পড়ে থাকবে! কেন পড়ে থাকবে। সে তো তার ক্যারিয়ারের জন্য অন্যত্র ছুটবেই।
বিষয়গুলো নিয়ে আসিফ আহমেদ বড্ড বেশি ভাবছেন। তিনি কিছুতেই মানতে পারেন না। তার মধ্যে ভয়ানক রকম অস্বস্তি হয়। অফিসের স্বার্থে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। কখনো কখনো ধৈর্যও ধরতে হয়। সেটা সে ধরেও। কিন্তু যখন ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়! লেবু অতিরিক্ত কচলালে তিতা হয়ে যায়। এটা সবাই জানে। তারপরও কচলাতেই থাকে। এই অফিসটাকেও লেবুর মতো কচলানো হচ্ছে। তাই অফিসটি দিনে দিনে তেতো হয়ে যাচ্ছে।
বিষয়গুলো নিয়ে আসিফ আহমেদ অনেকক্ষণ ধরে ভাবেন। তারপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি চাকরি করবেন না। তিনি নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করেছেন। অতঃপর তিনি একটি পদত্যাগপত্র লিখলেন।
শাহবাজ খান সকালে অফিসে এসেই আসিফ আহমেদকে ডেকে পাঠালেন। মিডিয়া অফিসের খুব কাছাকাছি করপোরেট অফিস। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এমডি সাহেবের অফিসে গিয়ে পৌঁছলেন। এমপি সাহেবের পিওন আসিফ আহমেদকে দেখেই বলল, স্যার আপনি এসেছেন? স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আসেন স্যার, আসেন।
আসিফ আহমেদ এমডি সাহেবের অফিসে ঢোকামাত্র তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন, তালিকা এনেছেন?
আসিফ আহমেদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন, সরি, কিসের তালিকা?
শাহবাজ খান বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আপনাকে না বললাম ছাঁটাইয়ের তালিকা করতে!
আসিফ আহমেদ নরম গলায় বললেন, ছাঁটাইয়ের তালিকা আমি করিনি। আর এ মুহূর্তে আমার পক্ষে ছাঁটাই করা সম্ভব নয়। ছাঁটাই করলে আমি চলে যাওয়ার পর করেন।
শাহবাজ খান বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, মানে!
আমি পদত্যাগ করছি। এ ছাড়া আমি কোনো বিকল্প পথ দেখছি না।
শাহবাজ খান বললেন, ঠিক আছে। আপনি যখন কিছুতেই আমার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছেন না; তখন আর কী করা! আমার তো অফিসটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে!
আমি কিন্তু আপনাকে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওই প্রস্তাবটি বিবেচনা করলে ছাঁটাইয়ের মতো মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। আসিফ আহমেদ বললেন।
শাহবাজ খান বললেন, আমরা ছাঁটাইয়ের বিকল্প কিছু ভাবছি না।
আসিফ আহমেদ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের হাতে ফাইলের ভেতরে রাখা পদত্যাগপত্রটি শাহবাজ খানের দিকে এগিয়ে দিলেন। তিনি পদত্যাগপত্রের দিকে একবার তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখাবয়বে যেন কালো ছায়া পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আসিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে। ভালো থাকবেন।
আসিফ আহমেদ বের হয়ে অফিসের দিকে গেলেন। তিনি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানরা ছুটে এল তার কক্ষে। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল, এমডি সাহেবের সঙ্গে মিটিং কেমন হলো? ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত কি স্থগিত করা গেছে?
আসিফ আহমেদ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেক যত্নে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেটি তাঁকে আজ ছেড়ে যেতে হবে। এই মর্মবেদনা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তারা ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। তিনি চলে গেলে যদি সবার চাকরি থাকত তাহলেও তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। তিনি চলে যাওয়ামাত্রই ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে। কতজন যে চাকরি হারায় কে জানে! বেতন হয়তো সবারই কমে যাবে।
আসিফ আহমেদকে বিমর্ষ দেখে কারো আর বুঝতে বাকি রইল না। তারপরও জানার কৌতুহল। সম্পাদকের মুখ থেকে শোনার কৌতুহল। কিন্তু সম্পাদক যে ভেতরে ভেতরে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে! নিজের আবেগ সংবরণের চেষ্টা চালাচ্ছেন তা কি কেউ বুঝতে পারছেন? তা বুঝতে পারলে হয়তো কেউ আর প্রশ্ন করত না।
অবশেষে আসিফ আহমেদ ধরা গলায় বললেন, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেক। পত্রিকাটাকে ভালো রেখ।
সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আসিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন