ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব- ৩০
বিষাদ বসুধা
শাহবাজ খানের ফোন পেয়ে মোহিনী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, কী আশ্চর্য! আমি তো তোমার কথাই ভাবছিলাম!
তাই নাকি? কী সৌভাগ্য!
কেন, সৌভাগ্য কেন?
তুমি আমার কথা ভাবছ! এটা আমার সৌভাগ্য নয়!
সত্যি বলছি। তোমাকে ফোন করব করব করছিলাম। এখন করব না দুপুরের দিকে করব এ রকম চিন্তা করতেই তোমার ফোন এল।
বাহ! খুব ভালো লাগল শুনে। তা হঠাৎ আমার কথা কেন মনে পড়ল শুনি!
আগে তোমার কথা শুনি। তারপর বলছি।
তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছ। কতদিন কোনো যোগাযোগ নেই, কথাবার্তা নেই। কী হয়েছে তোমার? একটা ফোনও তো করতে পারতে!
এই অভিযোগ তো আমিও করতে পারি।
হ্যাঁ। তা পার। তবে আমার কথা শুনলে তুমিই বরং বলবে, যোগাযোগ করা উচিত ছিল।
তাই? তাহলে আগেই আমি সরি বলছি। কী হয়েছে বল তো?
মোহিনী কিছুটা অন্য রকম হয়ে গেলেন। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার কোনো সাড়া না পেয়ে শাহবাজ খান বললেন, হ্যালো! আছ তুমি?
মোহিনী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আরেফিন মারা গেছে!
শাহবাজ খান বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, কী! কী বললে তুমি! কী হয়েছিল তার!
সে তো চীনের উহানে ছিল। যেখানে করোনার উৎপত্তি।
মাই গড! কবে ঘটল এই ঘটনা!
দশ দিন হয়ে গেল।
ওহ! মন খারাপ কর না। বিধাতা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
সে-ই। দোয়া কর।
অবশ্যই। তোমার কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
তোমার খবর বল। তোমার ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?
আর বল না! আমি তো ছাঁটাই করতে বাধ্য হলাম।
বল কী! তুমি ছাঁটাই করলে তো কেউ আর বাদ থাকবে না। সবাই শুরু করে দেবে!
শাহবাজ খান বললেন, কিছুই করার নেই বন্ধু। তিনটা গার্মেন্টস বন্ধই করে দিতে হয়েছে। তিনটাতে প্রায় সাতাশশ’ কর্মী ছিল। এতগুলো মানুষের বেতন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কয়েকশ’ গার্মেন্টস এরমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। আরও কতশত বন্ধ হয় তা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। ভয়ানক অবস্থা তো! মোহিনী বললেন, বুঝতে পারছি। তোমার পত্রিকার খবর কী?
একই অবস্থা। পত্রিকার মাসিক আয় দুই কোটি টাকা কমে গেছে। বেসরকারি বিজ্ঞাপন এক ইঞ্চিও নেই। ফলে পত্রিকার প্রকাশনা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে গেছে।
মোহিনী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, এ রকম অবস্থা?
তাহলে আর বলছি কী? সম্পাদককে ডেকে বললাম, লোক ছাঁটাই করেন। তা নাহলে পত্রিকা বন্ধ করে দিতে হবে। আমার পক্ষে এত খরচ দেওয়া সম্ভব না।
সম্পাদক কী বললেন?
উনি রাজি হচ্ছেন না। বললেন, এই মুহূর্তে ছাঁটাই করতে গেলে বদনাম হবে। আচ্ছা, আমি যদি বেতনই দিতে না পারি তাহলে ওসব বদনামের চিন্তা করে লাভ আছে?
তোমার পত্রিকাটা কিন্তু খুব ভালো। মানসম্পন্ন। রুচিশীল। আমি নিয়মিত পড়ি।
সেটা ঠিক আছে। কিন্তু খরচ তো অনেক বেশি। আয়-রোজগার না থাকলে টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। তোমার অফিসের খবর কী?
আমি এখনো ছাঁটাই করিনি। চালিয়ে যাচ্ছি। মোহিনী বললেন।
শাহবাজ খান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, বাব্বা বল কী!
দোয়া কর যেন ছাঁটাই করতে না হয়। এই সময় লোকগুলো যাবে কোথায়! এই সময় কেউ চাকরি দেবে? সবাই টিকে থাকার লড়াই করছে।
হুম। তোমার কথা ঠিক। কিন্তু আমি এতবেশি খরচ বাড়িয়েছি! আর সামাল দিতে পারছি না।
বুঝতে পারছি। আচ্ছা শোন, ঈদের পর একদিন এস। অনেক দিন তোমাকে দেখি না।
ধন্যবাদ। আসব, অবশ্যই আসব। তুমি ভালো থেক। চিন্তা কর না। ধৈর্য ধর। সময়ই সব ঠিক করে দেবে।
ইনশাল্লাহ। তুমিও ভালো থেক।
মোহিনী ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। ভাবেন শাহবাজ খানকে নিয়ে। এই ছেলেটির সঙ্গে তার স্কুল জীবন থেকে পরিচয়। কোনো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল। সেই সূত্রে ওদের মধ্যে কথাবার্তা হতো। কলেজে ওঠার পর শাহবাজ খান মোহিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিল। সেই প্রস্তাব মোহিনী গ্রহণ না করে বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে, প্রেম নয়। সবার সঙ্গে প্রেম হয় না। প্রেমটা হচ্ছে অন্তরের ব্যাপার। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। হৃদয়ে হৃদয়ে মিলতে হয়। দুই হৃদয় এক না হলে প্রেম হয় না। তোমার মন আমাকে চাইলেও আমার মন সায় দেয় না। অন্য কেউ হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তারপরও শাহবাজ খান বলেছিলেন, আমি অপেক্ষায় থাকব। সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যেদিন তোমার হৃদয় সায় দেবে সেদিন আমাকে বোলো আমি ছুটে আসব তোমার কাছে।
মোহিনী শাহবাজ খানের কথা শুনে শুধু হেসেছিলেন। সে কী হাসি! হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছিলেন। আর মনে মনে বলেছিলেন, আহারে আমার মজনু রে!
শাহবাজ খান ভীষণ অপমানবোধ করেছিলেন। তিনি মনে মনে বলেছিলেন, কেন ওভাবে হাসল সে! আমাকে কেন ওর এত অপছন্দ? আমি কি দেখতে খারাপ? আমার কি অর্থ সম্পদের কোনো অভাব আছে? নাকি আমার ব্যবহার খারাপ? সমস্যা কী? কোথায় সে বিয়ে করে আমিও তা দেখে নেব।
শাহবাজ খান হাল ছাড়েননি। তিনি মোহিনীর জন্য অপেক্ষা করেন। নিয়মিত যোগাযোগ করেন। টেলিফোনে কথা বলেন। গল্প করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর শাহবাজ খান বিদেশে পড়তে চলে যান। সেটাই সম্ভবত দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। অনেকদিন দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগই ছিল না।
কথায় আছে না, এক হাতে তালি বাজে না! একপেশে ভালোবাসাও খুব বেশি দূর আগায় না। মোহিনীর প্রতি শাহবাজ খানের ভালোবাসাও হয়তো সে কারণেই স্থায়ী হয়নি। আস্তে আস্তে মোহিনীকে তিনি ভুলে যান। মোহিনীও ভুলে যান শাহবাজ খানকে।
শাহবাজ খান দেশে ফিরে মা বাবার পছন্দে বিয়ে করেন। ব্যবসায় মনোযোগ দেন। নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মোহিনীও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বন্ধু আরেফিনকে বিয়ে করেন। পিতার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। এক পর্যায়ে নিজেই আলাদাভাবে সু-ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন। তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
হঠাৎ একদিন মোহিনীর অফিসে এসে হাজির হন শাহবাজ খান। তাকে দেখে অবাক হন তিনি। কথাগুলো আজ বড় মনে পড়ছে মোহিনীর। উদাস হয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। মনে মনে বলেন, জীবন বড় বিচিত্র।
মোহিনী নিজের অফিস কক্ষে পা দিয়ে চমকে ওঠেও। তার টেবিলের ওপর নানারকম তাজা ফুলের বিশাল একটি বাস্কেট। ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আজ মোহিনীর ভেতরে অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। আজ তার জন্মদিন। ওই ফুলগুলোই তাকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। করোনার কারণে জন্মদিন পালন করবেন না বলে মোহিনী আগে থেকেই তার মা বাবাকে বলে রেখেছিলেন। তারা হয়তো সকালে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেন। কিন্তু তাদের ঘুম ভাঙার আগেই মোহিনী বাসা থেকে বের হয়ে যান।
এর আগের বছরগুলোতে মোহিনীকে ওর মা-বাবা এবং বিয়ের পর আরেফিন সর্বপ্রথম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেন। তাদের পর বন্ধুবান্ধবরা শুভেচ্ছা জানাত। কেউ টেলিফোন করে। কেউ ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়ে। আজই জীবনে প্রথম অফিসে এসে ফুলের বাক্সেট দেখলেন তিনি।
মোহিনী ধীরে ধীরে ফুলগুলোর কাছে এগিয়ে যান। কে ফুল পাঠিয়েছে তা দেখেন। তিনি যা ভেবেছিলেন তাই! শাহবাজ খান পাঠিয়েছেন। ভীষণ একটা ভালোলাগা তাকে আচ্ছন্ন করে। তিনি মোবাইল বের করে শাহবাজকে ফোন করার জন্য। হাতে নিয়ে দেখেন ফোনটা বন্ধ। তিনি ফোনের সুইস অন করেন। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য শুভেচ্ছা বার্তা আসতে থাকে তার ম্যাসেঞ্জারে। ম্যাসেঞ্জার দেখতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তাই তিনি ম্যাসেঞ্জার না দেখে শাহবাজ খানকে ফোন করেন। তাকে তিনি ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে তার জন্মদিন মনে রাখার জন্য। এরমধ্যেই টেলিফোনে মোহিনীর বাবা মোহসীন আহমেদ, মা আনোয়ারা বেগম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। আসিফ আহমেদ এবং মোহিনীর অন্য কাছের বন্ধুরাও একের পর এক টেলিফোন করতে থাকে। জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত হন মোহিনী।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মোহিনীর কক্ষে ফুল নিয়ে হাজির হয় তার অফিসের কর্মকর্তারা।
মোহিনী খুব বিনয়ের সঙ্গে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বললেন, ফুল দেখলে আমি অন্য রকম হয়ে যাই। আমি আপনাদের শুভেচ্ছায় অভিভূত। তবে করোনার সময় ফুলগুলো না আনলেও পারতেন। আপনারা এমনিতে শুভেচ্ছা জানালেও আমি খুশি হতাম।
কর্মকর্তারা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সরি ম্যাম। ভুল হয়ে গেছে।
মুহূর্তের মধ্যে ফুলের বাস্কেটগুলো সরিয়ে নেওয়া হলো মোহিনীর কক্ষ থেকে। করোনার কারণে কাউকে মিষ্টি খাওয়ানো সম্ভব হলো না। মোহিনী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বললেন, করোনা শেষ হোক। তারপর আমরা বেঁচে থাকলে সবাই একসঙ্গে খাব। আমরা এখন যে যার কাজে মনোযোগ দিই!
কর্মকর্তারা খুশি মনে মোহিনীর কক্ষ থেকে বের হলো। মোহিনী শাহনাজ বেগমকে ডেকে বললেন, তুমি একটা ঠিকানা লেখ তো!
শাহনাজ বেগম ডায়েরি খুলে কলম হাতে নিয়ে মোহিনীর টেবিলের সামনে দাঁড়াল। মোহিনী বললেন, আলী আকবর, গ্রাম: আজিমপুর, ডাকঘর: লতা, উপজেলা: মেহেন্দিগঞ্জ, জেলা: বরিশাল। তুমি আমার ব্যক্তিগত একাউন্ট থেকে প্রতি মাসে এই ঠিকানায় দশ হাজার করে টাকা পাঠাবে। বুঝতে পারছ? পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাঠাতেই থাকবে। প্রতি মাসে আমাকে যেন বলতে না হয়। পাঠিয়ে আমাকে জানাবে।
জি ম্যাম।
যাও। চলতি মাসেরটা এখনই পাঠিয়ে আমাকে জানাও।
শাহনাজ বেগম চলে গেল। মোহিনী অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে গিয়েও পারছিলেন না। একের পর এক টেলিফোন আসার কারণে তিনি কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, কী ব্যাপার! করোনায় সবাইকে কর্মবিমুখ করে দিয়েছে নাকি! কাজ না থাকলে মানুষ এসব কাজে সময় নষ্ট করে। আর এটা যদি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তাহলেই সর্বনাশ!
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন