ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৯
বিষাদ বসুধা
আসিফ আহমেদ সকাল সকাল অফিসে এসেছেন। অফিসে এসেই বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান নূরুজ্জামান ও হিসাব বিভাগের প্রধান মনির হোসেনকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। ঈদের আগে তিন মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। শুরুতেই আসিফ আহমেদ বললেন, আমি কয়েকটি পয়েন্ট বলছি। সেগুলো মাথায় রাখ। প্রথমত, করোনার কারণে এবার যে অবস্থা হয়েছে তাতে বোনাস দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, পাওনাদারদের টাকা ঈদের আগে দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আমাদের এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বেতন পরিশোধ করা। তিন মাসের বেতন পরিশোধ করতে না পারলে বিরাট ঝামেলায় পড়ব। ঈদের পর কেউ কোনো টাকা দেবে না। কারো টিকিটিও ছোঁয়া যাবে না। যা করার ঈদের আগেই করতে হবে। এখন মনির বল, তোমার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে। এমডি সাহেব যে টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন সেটা কবে নাগাদ পেতে পার।
মনির হোসেন বলল, এমডি স্যার তিনটি চেকের মাধ্যমে ষাট লাখ টাকা দিয়েছেন। এই টাকাটা ব্যাংকে জমা হলে এক মাসের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে।
আচ্ছা। সেই এক মাসেরটাই আগে দিয়ে দিও। বাকি দুই মাসের বেতন জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে। দেরি করবে না। সবাই যখন এক সপ্তাহের মধ্যে তিন মাসের বেতন পাবে তখন সবাই খুশি থাকবে। বোনাস নিয়ে ওতো মাথা ঘামাবে না। বুঝতে পারছ?
জি স্যার।
আচ্ছা। তাহলে তোমার আর কত টাকা দরকার হবে?
মনির হোসেন বলল, ঈদের আগে বাকি দুই মাসের বেতন দিতে হলে প্রায় দুই কোটি টাকা প্রয়োজন। পাওনাদারদের বলেকয়ে না হয় ঈদের পরে দিলাম। দুই কোটি টাকার এক টাকা কম হলেও আমরা কিন্তু বেতন শেষ করতে পারব না। আর পোস্ট ডেটেড চেক এলেও হবে না। ওগুলো জমা হতে হতে ঈদের পর চলে যাবে। ঈদের আগে আমাদের হাতে আর দশ দিন সময় আছে। এরমধ্যে দুই শুক্রবার বন্ধ। দুই শনিবারও বেশির ভাগ বন্ধ থাকে। কাজেই হিসাব করলে সময় কিন্তু আছে ছয় দিন। এই ছয় দিনের মধ্যেই বিজ্ঞাপন বিভাগকে যা করার করতে হবে।
নূরুজ্জামান ঢাকার চার অঞ্চলের চার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানাল, আমরা আশা করি ঈদের আগে বেতনের টাকাটা জোগাড় করতে পারব।
ধন্যবাদ। দেখ ঝামেলায় ফেল না ভাই। আমি কিন্তু ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় আছি।
ঠিক আছে স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না।
দেখ আমার যদি আরও কোথাও বলতে হয় বলে দিই। তারপরও ঈদের আগে বেতনের ঝামেলা আমি শেষ করতে চাই।
জি স্যার। সেটা আমি বলব। তবে আশা করি আর বলতে হবে না। আপনি তো বেশ কয়েক জায়গায় বলে চেক এনেছেন।
তা এনেছি। সেটা কোনো সমস্যা না। এটা একটা টিম ওয়ার্ক। সবাই মিলে আমাদের কাজ করতে হবে। সংকটের সময় টিমওয়ার্কটা আরও বেশি প্রয়োজন। তোমরা দেখ। আরও যদি কোথাও বলতে হয় বলব। যেতে হলে যাব। কোনো অসুবিধা নেই। গ্রামীণ দিয়েছে?
আজ দেওয়ার কথা স্যার।
শোন, গ্রামীণের সিইও কিন্তু আমার খুব ঘনিষ্ঠ। যদি কোনো সমস্যা হয় আমার কথা বোলো।
স্যার, আপনাকে বেঁচেই তো খাচ্ছি।
নূরুজ্জামানের কথা শুনে আসিফ আহমেদ হেসে উঠল। মনির হোসেনও হেসে দিয়ে বলল, হ স্যার। কথাডা মন্দ কয় নাই।
যেভাবেই হোক টাকা আনুক। আমার কোনো অসুবিধা নেই। রবি, বাংলালিংক তারপর ইউনিলিভার, প্রাণ-আরএফএলসহ বড় কোম্পানিগুলোকে ভালো করে ধর। এদের কাছেই তো আমার বেশির ভাগ টাকা পড়ে আছে। আসিফ আহমেদ বললেন।
জি স্যার। আমি এখন তাহলে যাই। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যেই জোগাড় করতে হবে। শেষ দিনের আশায় থাকা যাবে না। শেষ দিন যা পাই সেটা জমা থাকুক। ঈদের কাজে লাগবে।
মনির হোসেন বলল, সেটা হলে তো আলহামদুলিল্লাহ। ঈদের পর পাওনাদাররা হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাদের টাকাটা জোগাড় করে যেতে পারলে বিরাট কাজ হবে।
এ কথা শুনে আসিফ আহমেদ ভীষণ খুশি। তিনি নূরুজ্জামানকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি যদি আগামী তিন দিনের মধ্যে বেতনের টাকা আনতে পার তাহলে বিশেষ বকশিস তুমি আমার কাছ থেকে পাবে।
নূরুজ্জামান বলল, ধন্যবাদ স্যার। দেখি কী করা যায়।
নূরুজ্জামান চলে যায়। মনির হোসেনও বিদায় নেয়। এর পরপরই সম্পাদকের কক্ষে আসে চিফ রিপোর্টার ও মফস্বল সম্পাদক। চিফ রিপোর্টার কথা বলতে গিয়ে মুখে আটকে গেল। ঠিক বোঝা গেল না কি বলেছে সে। আসিফ আহমেদ জানতে চাইলেন, তোমার কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। কী বলতে চেয়েছ বল তো!
আ-আ-আমি আজ বাজার নিয়ে যেতে না পারলে ঘরেই ঢুকতে পারব না। ব-ব-বউ খুবই রেগে আছে। তিন দিন ধরে বা-বা-বাজারের কথা বলে। কিন্তু আমি এড়িয়ে যাই। তার কথা শুনেও না শোনার ভান করি। সকালে গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখি স্টার্ট নেয় না। ঘটনা কী! দেখা গেল তেল নেই। ছেলের কাছ থেকে একশ’ টাকা নিয়ে তেল ভরলাম। তারপর অফিসে এলাম।
হুম। বুঝতে পারছি। আসিফ আহমেদ বললেন।
চিফ রিপোর্টার আবার বলল, জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে দু দফায় টাকা ধার নিয়েছি। এখন ধার চাইতেও লজ্জা লাগে। সময় মতো পরিশোধ না করলে কেন দেবে বার বার? আসিফ ভাই, বেতন কি আজকে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
দেখি। এমডি সাহেব কিছু টাকা দিয়েছে। ওই টাকা জমা হলে হয়তো আজকেও হয়ে যেতে পারে।
বেতনটা হলে যে কী বাঁচা বাঁচি!
মফস্বল সম্পাদক বলল, আমার ওয়াইফ বলল তুমি তো ঠিক মতো বেতনটেতন পাচ্ছ না; আমরা বরং গ্রামে চলে যাই। কিছুদিন গ্রামে থেকে আসি। গ্রামে পাঠাতেও তো টাকা দরকার। সেই টাকাও পকেটে নেই। তিন মাস পর বেতন পেলে কি চলা সম্ভব? যে টাকা বেতন পাই তা সবই খরচ হয়ে যায়। জমা থাকে না। ধার করে কতদিন চলা যায়!
আসিফ আহমেদ দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি অফিসে এসেই বিজ্ঞাপন ও হিসাব বিভাগের সঙ্গে বসছিলাম। ওরাও চেষ্টা করছে। আজ না হলেও কাল এক মাসের বেতন পেয়ে যাবে।
চিফ রিপোর্টার সম্পাদককে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আপনার চেষ্টাটা আমাদের সবারই চোখে পড়ছে। যাকগে, আমরা তাহলে মিটিংটা শেষ করি।
কী কী আছে আজকে? দিনের ঘটনা, বিশেষ রিপোর্ট? সম্পাদক জানতে চাইলেন।
চিফ রিপোর্টার বললেন, করোনার দিনের ঘটনা থাকবে। এ ছাড়া করোনায় খাতওয়ারি ক্ষতির রিপোর্ট আজ হাতে পাব। কয়েকজন রিপোর্টার এটা নিয়ে কাজ করছে।
মফস্বল থেকেও আসবে। এ ছাড়া জেলাগুলোতে করোনার টেস্ট ও চিকিৎসা অবকাঠামো কী আছে সে বিষয়ে রিপোর্ট পাব। মফস্বল সম্পাদক যোগ করল।
ভাই, চিকিৎসক, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন কিন্তু খুব ভালো ভূমিকা রাখছে। এদের বিষয়ে একটা ইতিবাচক রিপোর্ট কিন্তু করা যায়। চিফ রিপোর্টার বলল।
আসিফ আহমেদ বললেন, কেন নয়? অবশ্যই করাও। মানুষের বিপদে যারা পাশে দাঁড়াবে তাদের নিয়ে অবশ্যই রিপোর্ট করতে হবে। তাহলেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
জি জি। আর বিকেলের মিটিংটা আমরা অনলাইনে সেরে ফেলতে পারি। এখন তো একসঙ্গে বসাটা একটু সমস্যা! আপনার বোধহয় আরেকটা মিটিং আছে! চিফ রিপোর্টার বলল।
হুম। ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই। আমি আছি।
এ সময় আসিফ আহমেদের ফোনের রিং বাজে। ফোন ধরতে ধরতে চিফ রিপোর্টার ও মফস্বল সম্পাদককে বিদায় জানায়। ওরা চলে যাওয়ার পর তিনি ফোনে কথা বলা শুরু করেন।
পত্রিকা অফিসে সাধারণত ঈদের ছুটি তিন দিন। ঈদ একদিন পেছালে ছুটি একদিন বাড়ে। এবার আগেভাগেই চার দিন ছুটি ঘোষণা করেছে সংবাদপত্র মালিক সমিতি। ঈদের ছুটি ঘোষণার আগেই তিন মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন আসিফ আহমেদ। এক সপ্তাহের মধ্যে তিন মাসের বেতন পেয়ে সাংবাদিক-কর্মীরা মহা খুশি। তারা একে একে সম্পাদকের দপ্তরে এসে তাকে ধন্যবাদ জানায়। অনেকে বলে, ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর।
সম্পাদককে ধন্যবাদ জানিয়ে মামুন রশিদ বলল, এটা কী করে সম্ভব হলো? এক সপ্তাহের মধ্যে তিন মাসের বেতন! সত্যিই কী পেরেসানিতেই না পড়েছিলাম! আপনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন।
আসিফ আহমেদ বললেন, আমরা ভাবছিলাম হয়তো দুই মাসের বেতন হলেও হতে পারে। তিন মাসের বেতন একসঙ্গে পাব একটা ভাবিনি। আমার যে কী আনন্দ লাগছে তা আর কী বলব!
রিশিত খান বলল, কেউ কেউ তো বলা শুরু করেছিল, আপনি পারছেন না। আর এখন তাদের বোল পাল্টে গেছে। এখন কি বলছে জানেন?
আসিফ আহমেদ বললেন, কী বলছে?
এখন বলছে, আপনার কোনো তুলনা হয় না। আপনি সত্যিই ক্যারিসম্যাটিক লিডার। রিশিত খান বলল।
মামুন রশিদ রিশিত খানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল, আমার কানেও এসব কথা এসেছে। আমি বলতে চাইনি। আসলে সব অফিসেই বোধহয় কিছু লোক থাকে। তারা সব সময় দোষ খুঁজে বেড়ায়। সেটা যখন আবার মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন তারা বোল পাল্টে ফেলে।
এ সময় নূরুজ্জামান সম্পাদকের কক্ষে এসে বলল, স্যার আপনার দিক-নির্দেশনার কারণেই আমরা সফল হয়েছি। হিসাব বিভাগের মনির সাহেবকেও ওই দিন শক্তভাবে না বললে সে উল্টাপাল্টা কাজ করত। পরিবহনের টাকাটা আগে দিয়ে দিত। ওদের টাকা আগে দিলে আর বেতন দিতে হতো না। পরিবহনের কাছ থেকে ওরা কোনো কমিশন পায় কি না!
আসিফ আহমেদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাদ দাও তো ওসব কথা! শোন, তোমাকে বলেছিলাম না, ঈদের আগে তিন মাসের বকেয়া পরিশোধ করতে পারলে তোমাকে বকশিস দেব! এই নাও। এটা রাখো।
নূরুজ্জামান ভীষণ খুশি। সে সম্পাদকের পায়ে সালাম করে বলল, স্যার আপনার কোনো তুলনা নেই। আপনি যা করলেন!
ধন্যবাদ। আমি শুধু গাইড করেছি। তোমরা চেষ্টা না করলে তো কিছুই হতো না। আমি বিধাতার কাছে শুকরিয়া জানাই। আমি যা চেয়েছিলাম তাই হয়েছে। সত্যিই আমার ঈদটা স্বস্তিতে কাটবে।
নূরুজ্জামান বলল, আপনার ওপর বাপ-মায়ের দোয়া আছে স্যার। আপনি অনেক বড় হবেন। সত্যিই অনেক বড় হবেন।
উপস্থিত সবাই নূরুজ্জামানের কথায় সায় দিল।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন