ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৮
বিষাদ বসুধা
সাত-সকালে আসিফ আহমেদের ফোন পেয়ে বিস্মিত মোহিনী। তিনি ফোনের স্ক্রিনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ফোনের সাউন্ড টোন অফ করে দিলেন। ফোন ধরলেন না। পরে কথা বলবেন ভেবে রেখে দিলেন। কেন ফোন করেছে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। পত্রিকার বিলটা কি এখনো দেয়নি! আমি বারবার বলার পরও কেন বকেয়া রাখা হলো? নাকি অন্য কোনো কারণে ফোন করেছে!
মোহিনী মোবাইল হাতে নিয়ে তার প্রশাসন বিভাগের জিএম আবুল কালামকে ফোন করলেন। তাকে বললেন, আচ্ছা আসিফ সাহেবের পত্রিকার বিলটা কি দেওয়া হয়নি?
জি ম্যাম, দিয়েছি তো! কেন, আপনাকে কিছু বলেছে নাকি?
না না! কোনো বকেয়া নেই তো?
জি না। আপনি বললেন না, যা পাওনা আছে সব দিয়ে দিতে!
হুম। ঠিক আছে। ভালো করেছেন। আচ্ছা শোনেন, আমি অফিসে আসছি। আপনারা একটা কাজ করেন।
জি ম্যাম।
ঈদে আমরা দশ হাজার মানুষকে সহায়তা দিতে চাই। আপনি দশ হাজার প্যাকেট তৈরি করেন। এতে থাকবে, দশ কেজি চাল, দুই কেজি আটা, এক লিটার সয়াবিন তেল, পেয়াজ এক কেজি, আলু দুই কেজি এবং লবণ এক কেজি।
জি আচ্ছা।
এখনই আপনি কারওয়ান বাজার পাঠিয়ে দেন। আমি অফিসে এসেই যেন দেখি কেনাকাটা হয়ে গেছে। অ্যাকাউন্টস থেকে টাকা নেন। আমি এসে সই করে দেব।
জি ম্যাম।
মোহিনী আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আসিফ আহমেদকে ফোন করলেন। আসিফ ফোন ধরেই বললেন, শুভ সকাল। কেমন আছ?
শুভ সকাল। সাতসকালে সম্পাদক সাহেবের ফোন পেয়ে আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
তাই নাকি? সরি। আমি আসলে তোমার সঙ্গে ফ্রিলি একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম! ভাবলাম, এখনো তুমি অফিসে যাওনি। কাজের মধ্যে থাকলে কথা বলা মুশকিল!
হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছ। তারপর, আমার অফিসের বকেয়া সব পেয়েছ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি বলার পর বকেয়া রাখার সাধ্য কার?
সেটা না। তুমি বেতন দিতে পারছ না শুনে আমি বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এর আগেও কি আমাকে ফোন করেছিলে নাকি?
হুম। দু তিন বার তো করেছিলাম। তোমার ফোনটা বন্ধ ছিল। সাধারণত, তোমার ফোন তো বন্ধ থাকে না।
ঠিকই বলেছ। আমার ফোন বন্ধ থাকে না। আমি সাত দিন একদম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কোথাও যায়নি। বাসায় কাটিয়েছি।
কোনো বিশেষ কারণে?
তোমাকে তো বলা হযনি। আরেফিন মারা গেছে।
কি! এটা তুমি কী শোনালে!
হুম। উহানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
তারপর!
লাশ এসেছে ঢাকায়। দেখারও সুযোগ পাইনি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কবর হয়েছে।
খুব দুঃখজনক। এই বয়সে একটা মানুষ মারা যাওয়া!
এটাই হয়তো আমার কপালে ছিল। কপালের লিখন তো আর খণ্ডন করার উপায় নেই! যাকগে, তোমার খবর বলো।
না মানে, তোমার এই খবর শোনার পর আর কী বলব? সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।
এটা জীবনের অংশ। এ নিয়ে আমি মন খারাপ করছি না। আমি ভাবছি, কাজের মধ্যে ডুবে থাকব। তাহলে আর এসব ভাবনা মাথায় আসবে না।
সেটাই ভালো। তুমি কাজের মানুষ। তোমার একটা গুডউইল আছে। এটা শুনলেও ভালো লাগে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বিরাট উপকার হয়েছে। আশা করছি ঈদের আগে সব পাওনা মিটিয়ে দিতে পারব।
বাহ! তাহলে তো খুবই ভালো। আর খবর কী বলো তো? ছাঁটাই কি করতেই হচ্ছে।
এখনো কাউকে করা হয়নি। তবে ব্যাপক চাপ। আমি হয়তো থাকব না।
সে কী!
কী করব বলো? আমি বিকল্প প্রস্তাব দিলাম। সেগুলো তাদের পছন্দ হচ্ছে না। ছাঁটাই না করেও কী করে খরচ মিনিমাইজ করা যায় সে বিষয়ে আমি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। প্রস্তাবটা ভালো কী মন্দ তাও তারা দেখেনি। তাদের এক কথা ছাঁটাই করতেই হবে। আমি নিজের চাকরি বাঁচাতে ছাঁটাই করব? সে মানুষ আমি নই।
তা তো জানি। আচ্ছা, আমি কি কথা বলে দেখব?
তুমি কথা বলবে! সেটা কি ঠিক হবে?
আমি তো আর তোমার বিষয়ে কিছু বলব না! ওর পত্রিকার বিষয়ে জানতে চাইব। কী করবে না করবে সে বিষয়ে। মনোভাবটা তো বোঝা যাবে!
হুম। আচ্ছা সে কি জানে তুমি আমার বন্ধু?
আমি একবার কথায় কথায় বলেছিলাম। নিশ্চয়ই সেটা মনে আছে। থাকার কথা আর কি!
আচ্ছা আচ্ছা। তুমি আমার বিষয়ে কিছু বোলো না। তুমি অন্যভাবে জানার চেষ্টা করো।
তা তো অবশ্যই। আমি একটা কথা বলব?
প্লিজ!
তুমি হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। জানোই তো সময়টা এখন খুব খারাপ।
তা তো জানি। কিন্তু কী করব বলো। প্রত্যেকটা মানুষেরই তো একটা নীতি থাকে। তাই না? আমি জানি, আমি যদি এখন ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে তারা আমাকে মাথায় করে রাখবে। কিন্তু আমার পক্ষে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। ছাঁটাইয়ের আগে আমার নিজের ইস্তফা দিতে হবে। তা না হলে আমি মনপীড়ায় ভুগব। তা ছাড়া, আমার ক্যারিয়ার আছে না! সাংবাদিক মহলে আমি মুখ দেখাতে পারব? সবাই ছি ছি করবে। তুমিও বলবে, সম্পাদক হয়ে তুমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারলে! তখন কী জবাব দেব?
হুম। বুঝতে পারছি। মুনমুন ভাবি কী বলেন?
সেও তো চাকরি করে। বোঝে বিষয়টা। তা ছাড়া, সেও বলে দিয়েছে, ছাঁটাই করে তুমি নিজেও চাকরি করতে পারবে না। মানসিক যন্ত্রণায় তুমি শেষ হয়ে যাবে। তারচে’ তুমি ছেড়ে দাও। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই সময় তো কোথাও চাকরিও পাবে না।
শোনো, চাকরি তো অনেক করলাম। এবার কিছু সময় রেস্ট নিই। তারপর দেখি কি করা যায়।
যা-ই করো আমাকে জানিও।
তা তো বটেই। এই দেখ, সকাল থেকে শুধু নিজের কথাই বলছি। তোমার কথা তো কিছু শোনা হলো না। তুমি কেমন আছ?
আমার কথা আরেকদিন শুনো। এখন আমার অফিসে যেতে হবে। গত সাত দিন বাসায় কাটিয়েছি। অফিসের কী অবস্থা জানিও না। তুমি ভালো থেকো। মন খারাপ করো না।
তুমিও ভালো থেকো।
মোহিনী ফোন রেখে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন। তারপর অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।
মোহিনীর অফিসে খাদ্যদ্রব্য প্যাকেট করা হচ্ছে। কে কোন পদে চাকরি করছে সে কথা ভুলে গিয়ে সবাই প্যাকেট করার কাজে হাত লাগিয়েছে। এ দৃশ্য দেখে মোহিনী অফিসের সামনে থমকে দাঁড়ালেন। তিনি দাঁড়িয়ে থেমে কর্মযজ্ঞ দেখছেন। যেন এক মহাযজ্ঞ চলছে। দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে গেল।
মোহিনী কখন এসে দাঁড়িয়েছেন তা অফিসের কেউ টেরও পায়নি। মোহিনী এমনই। কোনো রকম ভাব নেই। কোনো রকম আত্ম-অহমিকা নেই। অতি সাধারণ একজন চাকরি জীবীর মতোই তার আচরণ, চলাফেলা। একেবারে সাদামনের মানুষ যাকে বলে! এ রকম মানুষ জগতে খুব কমই মেলে। মোহিনীর অফিসের লোকরা সে কথাই বলে। তাকে নিয়ে সবাই গর্ব করে। সবাই মনে করে, নিজের অফিসেই তারা কাজ করছে। তারা আর দশটা অফিসের চাকরিজীবীদের মতো নয়। ঘড়ি দেখে কিংবা ঘণ্টা হিসাব করে তারা কাজ করে না। সেভাবেই মোহিনী অফিসটাকে গড়ে তুলেছেন।
আবুল কালাম নানা কাজের তদারকি করছিল। কাজ করতে করতেই সে দেখল, মোহিনী অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। সে তার কাছে ছুটে গিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে মোহিনী থামিয়ে দিয়ে বলেন, আমি শুনব। তার আগে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমার অফিস এত চমৎকারভাবে কাজ করছে এ জন্য একটা ধন্যবাদ তো আগে দিই!
আবুল কালাম কাচুমাচু করে বলল, জ্বি ম্যাম, জি ম্যাম।
কাজে ডুবে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশ করে মোহিনী বললেন, আপনারা সবাই যেভাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন তাতে আমি খুবই আশাবাদী। এই দেশ অবশ্যই সব সংকট মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
মোহিনীর কথায় সবাই আরও বেশি উৎসাহ পেল। সবাই আরও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করল। আনন্দে মোহিনীর বুকটা অনেক চওড়া হয়ে গেল। তিনি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আবুল কালামকে দিয়ে বললেন, দুপুরে এদের সবাইকে খাইয়ে দেবেন।
আবুল কালাম উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন, জি ম্যাম. জি ম্যাম।
মোহিনী এবার অফিসের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আবুল কালামকে বললেন, আপনি আসেন। কি যেন বলতে চেয়েছেন!
আবুল কালাম আর কোনো কথা না বলে মোহিনীর পেছনে পেছনে এগিয়ে গেল। মোহিনী তার অফিসে পৌছার পর আবুল কালাম কিছুটা দ্বিধা এবং সংকোচের ভঙ্গিতে বলল, ম্যাম আমরা সবই কিনতে পেরেছি। কিন্তু একটু সমস্যা হয়ে গেছে।
কী সমস্যা?
চাল কিনতে গিয়ে আমাদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়েছে। কারওয়ান বাজার, বাদামতলী এবং আমিনবাজার ঘুরেও আমরা পুরো চাল কিনতে পারিনি। পাইকাররা বলল, চাল নেই। এই অজুহাতে তারা দামও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুরো চাল কিনতে পারি কি না..
এসব নেগেটিভ কথা বলবেন না তো! আমি পছন্দ করি না। অবশ্যই চাল পাওয়া যাবে। যা পেয়েছেন তা দেওয়া শুরু করুন। বাকি চাল দু’তিন দিন অপেক্ষা করে কিনে ফেলেন। দামের কথা বলার দরকার নেই। এই সময় দাম তো কিছু বেশি হবেই। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভালো মন্দ আছে না! সুযোগসন্ধানী আছে না! তারা তো সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সেনিটাইজার নিয়ে কী হলো মনে নেই!
আবুল কালাম নীচু গলায় বলল, সরি ম্যাম।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>