ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৪
বিষাদ বসুধা
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তাকে অপসারণ করুন। এমন দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়ে ওঠে। পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই তিনি হেডলাইন হচ্ছেন। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে অনেক ব্যঙ্গবিদ্রুপ লেখা ছাপা হচ্ছে। তার বিদ্রুপাত্মক কার্টুন ছাপা হচ্ছে। তিনি নিজে এবং তার লোকজন পত্রিকা অফিসে ধর্না দিচ্ছেন। পত্রিকার মালিকদের কাছে ছুটছেন। তাকে নিয়ে যেন লেখালেখি না হয় সেজন্য তিনি ব্যাপক তদবির করছেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় তিনি আছেন। আছেন আলোচনার টেবিলে। করোনা ঝড়ের সঙ্গে তার নামটিও জড়িয়ে গেছে। করোনা মানুষের মধ্যে যতই উদ্বেগ সৃষ্টি করছে তিনিও ঠিক তেমন উদ্বেগই ছড়াচ্ছেন।
এর আগে যখন করোনা শুরু হয়, ঠিক তার পরপরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে বিদেশে ভ্রমণে চলে যান। সে কী কাণ্ড সেই প্রমোদ ভ্রমণ নিয়েও পত্রিকায় একের পর এক রিপোর্ট ছাপা হয়। সমালোচনার ঝড় ওঠে সর্বত্র। সেই ঝড় গণভবনের উঁচু প্রাচীর ভেদ করে প্রধানমন্ত্রীর গায়েও লাগে। ঝড় থামাতে তিনি তড়িঘরি করে তাকে দেশে ডেকে আনেন। গণভবনে ডেকে নিয়ে ঠিকঠাক মতো কাজ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। দেশে ফিরেই তিনি উল্টাপাল্টা বক্তব্য শুরু করেন। তার সেই বক্তব্য নিয়েও পত্রিকা অফিসগুলোতে শোরগোল ওঠে। তার পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। সবাই বলাবলি করেন, এবার আর রক্ষা নেই। এবার তাকে বিদায় হতেই হবে। কিন্তু না। তিনি বিদায় হননি। তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। এর নেপথ্যে রহস্য কী তা খোঁজার চেষ্টা করে মানুষ।
এরমধ্যেই সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক দুর্নীতির খবর। একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু শাক দিয়ে কী আর মাছ ঢাকা যায়! একদিক ঢাকলে আরেকদিকে বের হয়ে যায়। এতেও তিনি বিব্রত হন না। লজ্জা পান না। টিভির সামনে বেশ হাসি মুখে কথা বলেন। একে ওকে দোষারোপ করেন। কখনো কখনো উট পাখির মতো মুখ লুকিয়ে থাকেন। ব্যাস। ওতেই যেন সব বিপদ কেটে যায়। আবার মাথা তুলে দাঁড়ান। গা ঝাড়া দিয়ে আবার স্বরূপে আবির্ভূত হন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনে মনে ভাবলেন, গণমাধ্যমকে হাত করতে হবে। তা না হলে বিপদ কাটবে না। ওরা উল্টাপাল্টা রিপোর্ট করে বলেই বিপদ! মালিকদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে হবে। গভীর সম্পর্ক। ওরা হাতে থাকলে আর চিন্তা করতে হবে না। তারা হাতে থাকলে এক অক্ষরও আমার বিরুদ্ধে লিখবে না। কিন্তু কীভাবে কাজটি করা যায়, কাকে দিয়ে করা যায়— ঠিক সেই সময়েই তার কাছে হাজির হন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। তাকে দেখেই তিনি বললেন, এই! আপনার সঙ্গে মিডিয়ার সবার খুব খাতির! তো, আমার জন্য একটা কাজ করেন না!
কি করতে হবে সেটা বলেন স্যার। আপনার জন্য আমি সব কিছু করতে পারব। সাহেদ করিম বললেন।
আগে কথা দিন, আমার জন্য আপনি করবেন।
কথা দিলাম স্যার। অবশ্যই করব।
না মানে আপনি বলছিলেন, মিডিয়ার সঙ্গে আপনার খুব খাতির।
জি স্যার। কথা মিথ্যা না। সবার সঙ্গেই আমার গভীর সম্পর্ক।
কীভাবে এতো সম্পর্ক তৈরি করলেন?
স্যার, খরচাপাতি করতে হয়। পার্টি টার্টি দিতে হয়। আমাকে টকশোতে দেখেন না? দেখেন তো!
হুম।
কীভাবে সম্ভব হলো? দেশে এতো মানুষ থাকতে আমাকে কেন ডাকে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?
হ্যাঁ তা ঠিক। কীভাবে সম্ভব হলো বলেন তো!
স্যার, ব্যাপারটা সিক্রেট। হা হা হা! আমার অ্যালবামটা দেখেন। ভালো করে দেখেন। তাহলেই বুঝবেন মিডিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন!
সাহেদ করিমের হাত থেকে অ্যালবামটা নিয়ে মন্ত্রী ছবিগুলোর উপর চোখ রাখেন। ছবির দিকে তাকিয়েই বলেন, বাব্বা! আপনার সঙ্গে তো দেখছি সবাই আছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, মিডিয়ার মালিক, সম্পাদক! ও মাই গড! কার সঙ্গে নেই! আপনি তো দেখছি বিরাট সেলিব্রেটি! আমি তো দেখছি বিরাট মিস করে ফেলেছি! আপনার সঙ্গে শুধু আমার ছবিই নেই।
সাহেদ করিম মাথা নিচু করে মুসকি মুসকি হাসে। ভাবখানা এমন যেন তার সঙ্গে ছবি তুলে মন্ত্রী সাহেবই ধন্য হয়ে যাবেন। অবশেষে মন্ত্রী সেই কাজটিই করে বসলেন। তিনি খুব আদবের সঙ্গে সাহেদ করিমকে ডাকলেন। আসেন আসেন! আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলি। তুলে ধন্য হই। তা না হলে যে বড় মিস হয়ে যাবে!
সাহেদ করিম সঙ্গে সঙ্গে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছবি তুললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। একটা নয়, দুইটা নয়, দশ-বারটা। তারপর সাহেদ মন্ত্রী সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন, স্যার আমার একটা হাসপাতাল আছে।
রিজেন্ট হাসপাতাল তো!
জি স্যার। আপনি জানেন!
জানি জানি। সবই জানি।
বাহ! এতো আমার সৌভাগ্য। স্যার, আমি সিদ্ধান্ত নিছি আমার হাসপাতালে করোনার ফ্রি টেস্ট করাব।
তাই! সে তো ভালো কথা! কবে শুরু করতে চান?
তার জন্য তো একটা চুক্তি করতে হয় স্যার!
করব, অসুবিধা কি? আপনি নিয়ে আসেন। আমি করে দেব।
স্যার, একটু প্রচারট্রচার...
মন্ত্রী সাহেব কিছুক্ষণ থেমে বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ও আচ্ছা। করে দেব। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটা যাতে ভালো করে প্রচার করা হয় সে ব্যবস্থা... আচ্ছা, আমি কি করব? আপনার সঙ্গেই তো সবার ভালো সম্পর্ক! আপনিই বরং সবাইকে ওই দিন ডাকুন।
সেটাই বলতে চাইছি স্যার। আপনি যদি মন্ত্রণালয়ে একটা অনুষ্ঠান করেন! মানে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিই যদি অনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে করেন তাহলেই..
ঠিক আছে ঠিক আছে। তাই করব। আপনি এতোবড় সেলিব্রেটি! আপনার সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে তো আমরা ধন্যই হবো!
কী যে বলেন স্যার। আমি ছোটোখাটো মানুষ। সবাই আমাকে ভালোবাসে আর কী! স্যার, আমার টকশোগুলো দেখেছেন তো?
হুম। অল্প কয়েকটা দেখেছি। খুব বেশি দেখিনি।
স্যার, আপনার দোয়ায় আমি সব টিভি চ্যানেলেই দাওয়াত পাই। কোনো কোনো দিন এমনও হয়, দুটি তিনটি টিভিতে যেতে হয়। সময় দেয়াই মুশকিল হয়ে গেছে স্যার।
বাহ! খুব ভালো, খুব ভালো। আপনার সঙ্গে কেন যে আরও আগে পরিচয় হলো না!
অসুবিধা নেই স্যার। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না! ওহ, ভুলে গেছি।
বেটার লেট দেন নেভার।
জি স্যার জি স্যার। ওটাই।
আপনাকে আমার জন্য কিছু কাজ করতে হবে। বুঝতে পারছেন?
জি স্যার। অবশ্যই করব স্যার। কি কাজ স্যার? যদি একটু আভাস দেন!
দেখছেন না, মিডিয়াতে আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা লেখে!
বুঝছি বুঝছি স্যার। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমি দেখবো। আমি সব ঠিক করে দেব।
আরেকটা কথা।
জি স্যার, বলেন স্যার।
টকশো মানুষ খুব দেখে; তাই না?
স্যার, টকশোই তো মানুষ দেখে। আর কিছু দেখে নাকি টিভিতে?
হুম হুম। তো, আমাকেও মাঝেমধ্যে ডাকতে বলেন না!
জি স্যার, বলব স্যার। আপনার সঙ্গে তো আমার সে রকম আলাপ-পরিচয় ছিল না! এখন আর সমস্যা নাই। আমি সব দেখব স্যার। আপনার ভাবনা আমি নিয়ে নিলাম স্যার।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ। আমি তাহলে আসি স্যার?
আসুন।
সাহেদ করিম চলে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্থির হয়ে বসলেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, একটা হাসপাতালের মালিক! তার কত ক্ষমতা! সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক! ভাবা যায়! নিশ্চয়ই লোকটার অনেক টাকা আছে! এই দেশে টাকা থাকলে কি না হয়! আমি ঘোড়ার ডিমের মন্ত্রী! আমাকে কেউ গোনায় ধরে না। উল্টো মানুষের গালমন্দ! মিডিয়াতে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট! মন্ত্রী হয়ে কি লাভ হলো! না, কিছু ভালো লাগে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কয়েকদিন ধরে টিভিগুলোর দিকে নজর রাখতে শুরু করলেন। বিশেষ করে টকশোগুলো দেখছিলেন। টিভিগুলোতে সাহেদ করিমের সরব উপস্থিতি দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, দেশে কী আর কোনো লোক নেই! একজনই আছে। সাহেদ করিম। আর সে যেভাবে কথাবার্তা বলছে তাতে তো মনে হয় দেশে সে-ই একমাত্র বোদ্ধা লোক। আর সবাই চুনোপুটি। যাকগে, যেই দেশে যেই ভাও। সাহেদ করিমকে হাতে রাখলে যদি আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা বন্ধ হয় তাহলে তাই করতে হবে! আর তার সঙ্গে যাদের ছবি দেখলাম! তাতে সন্দেহ করারও কোনো সুযোগ নেই। সবাই যখন আছে। আমি আর বাদ যাবো কেন।
সাহেদ করিমের কথা ভাবতে ভাবতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ফোন করলেন। ফোনে তাকে বললেন, কালাম সাহেব সাহেদ করিমকে তো চেনেন! রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি। সে আমার কাছে এসেছিল। তার হাসপাতাল থেকে করোনার ফ্রি টেস্ট করাতে চায়। আমাদের তো কোনো অসুবিধা নেই। বরং ভালো। আপনি তাকে ডেকে চুক্তিটা একটু দেখেন। তারপর একদিন অনুষ্ঠান করে চুক্তি সই করে ফেলবো।
মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ডিজি সাহেব তড়িঘরি করে সাহেদ করিমকে ডেকে চুক্তির খসড়া নিয়ে বসলেন। ভালো করে দেখলেন। তারপর মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে কথা বলে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করলেন। মন্ত্রণালয়ে সবার উপস্থিতিতে সাহেদ করিম এবং মহাপরিচালক চুক্তিতে সই করলেন। সবাইকে নিয়ে ছবি তুললেন। সেই ছবি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হলো। লোকজন জানতে পেরে করোনা পরীক্ষার জন্য ছুটলো রিজেন্ট হাসপাতালে। এই হাসপাতালটি সব কাজ বন্ধ করে দিয়ে শুধু করোনা পরীক্ষাই করছে। মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক সবাই করোনা টেস্টের জন্য লোক পাঠাচ্ছেন।
সাহেদ করিম তদবিরের ধরন বুঝে সেগুলো আগে-পরে করে দিচ্ছেন। এইভাবে বেশ কিছুদিন চলে যায়। কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতালের টেস্ট নিয়ে কারো কারো সন্দেহ হয়। সন্দেহ হওয়ার কারণও অবশ্য আছে। টেস্টের পরেও দেখা গেছে, করোনার লক্ষণগুলো তাদের শরীরে বিদ্যমান। এদের মধ্যে কেউ কেউ করোনার লক্ষণ নিয়ে মারাও গেছে। ফলে সন্দেহপ্রবণ অনেকেই দ্বিতীয়বার সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা পরীক্ষা করিয়ে দেখেছেন তারা করোনায় আক্রান্ত।
রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া পরীক্ষা ফাঁস হয়ে যায়। লোকমুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। লেখালেখি শুরু হয় ফেসবুকে। এ সব লেখালেখির খবর চলে যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কানে। তিনি শুরুতে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিনি ভেবেছিলেন, কিছু লোক ঈষান্বিত হয়ে এ সব করছে। কিন্তু সবকিছু জেনে মন্ত্রী বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, সর্বনাশ!
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/