ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৬
বিষাদ বসুধা
দুপুরের রোদে খা খা করছে চারদিক। রোদের উত্তাপে গাছের পাতাগুলো লজ্জাবতী গাছের মতো কেমন মিইয়ে পড়েছে। গাছপাতা, তরুলতাগুলোও যেন একটুখানি বাতাসের জন্য হা-পিত্তেশ করছে। কিন্তু বাতাসের কোনো নাম-গন্ধও নেই। গরমে হাঁসফাঁস করছেন জমিলা খাতুন। তিনি রান্না করতে গিয়ে গরমে হাপিয়ে উঠেন। কোথাও স্বস্তি নেই। শ্বাস-প্রশ্বাসও উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
জমিলা খাতুন তালের পাখা নিয়ে ঘরের বারান্দায় এসে বসলেন। এ সময় একটি কাক ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বাড়ির উঠানে বাঁশের আড়ার উপর বসে। তারপর শুরু করে ডাকাডাকি। একেবারে উথালিপাথালি ডাক। কাক ডাকার শব্দটা যেন কলিজায় গিয়ে লাগে। এমন ডাক খুব সহসা শোনেননি জমিলা খাতুন। কাকের ডাক শুনে বুক ধরফর করে উঠে তার। মনটা স্থির হয়ে উঠে। তিনি কাকটাকে হাত দিয়ে তাড়া করেন। যা কাক, যা। এমন করে কেন ডাকতেছিস? কার সর্বনাশের খবর নিয়া আইছিস ক তো? যা। আর সর্বনাশা ডাক ডাকিছ না। যা যা।
কাকটা কিছুতেই যায় না। এদিক উড়ে, ওদিক উড়ে। আবার বাঁশের উপর বসে। পড়ে পড়ে ডাকে। কা কা কা কা!
জমিলা খাতুনের কাছে কাকের ডাকটা ভয়ঙ্কর লাগে। তার ছেলের কথা মনে পড়ে। তার কলিজার টুকরা আরেফিন। পরিবারের একমাত্র রত্ন। একমাত্র মানিক। গ্রামের লোকেরা ওকে বলে, গোবরে পদ্মফুল। ওদের সংসারে সবাই গো-মূর্খ। কারও ভেতরে কোনো শিক্ষার আলো নেই। পূর্বপুরুষরাও কেউ কখনো স্কুল-কলেজে যায়নি। মেধার গুণে আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পেরেছে। তার মেধার মূল্যায়ন করেছেন মোহিনী। তিনি বড়লোকের মেয়ে হয়েও অতি নীচু পরিবারের সন্তান আরেফিনকে ভালোবাসেন। তাকে তিনি বিয়ে করেন। পাল্টে যায় আরেফিনের জীবনধারা। কত বড় ভাগ্য নিয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন কে জানে!
আরেফিন মা বাবার জন্য গ্রামে প্রতিমাসে টাকা পাঠান। যত ঝড়ঝাপটাই তার উপর দিয়ে যাক, মা বাবার কাছে টাকা পাঠানোর কথা ভোলেন না। আরেফিন এক দেশ থেকে আরেক দেশে যান, আর বাবার বুকের ছাতিম ফুলেফেঁপে বড় হয়। মার মুখে হাসি ফোটে। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ে আজিমপুর গ্রামে। একে বলে ওকে বলে, আমার সোনার মানিকের কথা শুনছ? বিরাট পাস দিছে আমার ছেলে। বিরাট চাকরি করে। বড়লোকের মেয়েরে বিয়া করছে। আর কি চাই?
কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে বলে, ছেলের বউরে কখনো দেখছ? খুব তো বড়াই করতেছ?
জোখের মুখে চুন পড়ার মতো অবস্থা হয় জমিলা খাতুনের। তিনি মাথা নিচু করে অন্য দিকে চলে যান। মনে মনে বলেন, সব হিংসা। এই দুনিয়ায় কারো ভালো কেউ কি দেখতে পারে! পারে না। হিংসায় জইলা পুইড়া মরে। নিজেগো পোলারা মাইনসের খেতে বদলা দেয়। আমাগো পোলায় লেখাপড়া কইরা ঢাকা শহরে বড় চাকরি করে। এইডা কি কারো সহ্য হয়। হয় না। এই জন্যই টিটকারি মাইরা কথা কয়। ওইসব আমি বুঝি না! সব বুঝি।
কিছুক্ষণ পর আবার কাকটা পড়ে পড়ে ডাকে। কা কা কা কা!
জমিলা খাতুনের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। কোনো একটা অঘটন ঘটছে। তা না হলে কাকটা এমন করে ডাকতো না। আরেফিনের বাপ কোথায় গেল! সারাদিন কই কই যে থাহে!
জমিলা খাতুন মনে মনে ছোটছেলেকে খোঁজেন। আক্কাস গেল কই? আক্কাস আক্কাস!
আক্কাস দৌড়ে আসে মা’র কাছে। কি হইছে মা?
দেখ তো তোর বাপ কই? তাড়াতাড়ি খুইজা আন।
আনতাছি মা। আনতাছি।
আক্কাস দৌড়ে দরজার দিকে যায়। বৈঠকখানায় বসে আক্কাসের বাবা আলী আকবর গল্পগুজব করছিলেন। গরমের দিনে বৈঠকখানায় বাড়ির লোকদের আড্ডা বসে। আড্ডার মধ্যমণি আলী আকবর। ছেলের কারণে আলী আকবর বাড়ির লোকদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছেন। তিনি না গেলে আড্ডা জমে না। তিনি যতক্ষণ বৈঠকখানায় থাকেন ততক্ষণই আড্ডা জমজমাট থাকে। বাড়ির লোকরা নানা বিষয়ে এখন আলী আকবরের পরামর্শ নেন। ভালোমন্দ জানতে চান। আলী আকবরও বিজ্ঞলোকের মতো যাকে যে পরামর্শ দেওয়া দরকার তা দিয়ে থাকেন। প্রতিদিনের মতো আজও আড্ডা বেশ জমে উঠে। আজ তিনি তার গর্বের ছেলেকে নিয়ে গল্প করছিলেন। কিভাবে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করল সেই গল্প। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আলী আকবরের গল্প শুনছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আক্কাস আলী সেখানে হাজির হয়। সে তার কাছে গিয়ে কানে কানে বলে, মা ডাকতাছে। কি যেন হইছে তার। কেমন জানি করতাছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলেন বাবা।
পরে জামু। তুই গিয়া ক, আমি একটু পর আসতাছি।
বাবা, এই কথা গিয়া কইলে মা রাগ করব। আপনি চলেন তো! পরে আইসা গল্প কইরেন।
আলী আকবর সবার উদ্দেশে বললেন, মিয়ারা, আমার গল্প শেষ হয়নি। আমি আবার আসতাছি। আইসা গল্প শেষ করব।
আলী আকবর হন হন করে হেঁটে বাড়ির দিকে ছুটে যান। জমিলা খাতুনের কাছাকাছি গিয়ে বলেন, কি হইছে আরেফিনের মা? এতো উতালা হইছ কেন? আমি আমার ছেলেরে নিয়া গল্প করছিলাম। সবাই উদাস হইয়া আমার ছেলের গল্প শুনছিল। সেইডা তোমার সহ্য হইল না?
আরেফিনের গল্প?
আর কার গল্প? গল্প কিংবা গর্ব করার মতোন আর কে আছে কও?
দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে জমিলা খাতুন বললেন, আমার আরেফিন! ওর লইগ্যা আমার মনডা কেমন জানি করতেছে। বুকের মধ্যে কী রহম জানি ধুকফুক ধুকফুক করতেছে। আপনে আরফিনের খবর নেন তো! কোনো সমস্যা হইল কি না পোলাডার।
কেন? আবার কি হইল?
কাকটা দেহেন না, এহনও পইড়া পইড়া ডাকতেছে। বড় অহস্য লাগতেছে।
ওসব বাদ দেও তো! কাক ডাকতাছে তাতে সমস্যা কি? কাক ডাকবো না?
আপনে আমার কতাডা একটু হোনেন। আপনে খোঁজ লন পোলাডার। খোঁজ লইতে তো কোনো দোষ নেই! খোঁজ লইয়া আমারে কন, পোলাডা ভালো আছে।
হুম, কয়দিন পর পর কাক ডাকবো আর তোমার মন উতালা হইব; এইডা কেমন কথা?
আপনে খোঁজ লইবেন? নাকি অন্য কাউরে কমু?
কও না কও। কারে কইবা? আরেফিন যে দেশে নাই এইডা কেউ জানে? মন খারাপ কইরো বউ। আরেফিন চীন দেশে গেছে। ছোডবেলায় চীনের গল্প হোন নাই? চীনরে বলে মহাচীন। সেই দেশে আমার ছেলে গেছে। ভালোই তো আছে কইল। খারাপ থাকলে ফোন কইরা জানাইতো না?
আপনের লগে কবে কতা হইছে?
ওইদিন, তাও তিন চাইর দিন হইয়া গেছে।
আজকে তো হয় নাই?
না। আজকে হই নাই। আচ্ছা, তুমি যেহেতু কইতেছ, আমি ফোন কইরা দেখতেছি।
আলী আকবর মোবাইল হাতে নিয়ে আরেফিনের নম্বরে ফোন দেন। কিছুতেই তার ফোনে ঢোকা যাচ্ছে না। একবার দুইবার তিনবার ফোন করেন তিনি। না। কিছুতেই ফোনে ঢোকা যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বিরক্ত হন। ভীষণ বিরক্ত হন। কিছুক্ষণ পর তিনি ছেলের বউর নম্বরে ফোন করেন। মোহিনীর ফোনে রিং বাজে। কিন্তুমোহিনী ফোন ধরছে না। মোহিনীর নম্বরেও কয়েকবার ফোন করেন তিনি। বিরক্ত হয়ে তিনি ফোনটাকে বিছানার উপর ছুড়ে মারেন।
জমিলা খাতুন স্বামীর কা-কির্তি দেখে বলেন, ওকি ওকি! ফোনডারে ছুইরা মারলেন যে!
আলী আকবর ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আইজ কি হইল বুঝতে পারতেছি না। কুফা লাগছে। পাইতেছি না। কাউকেই পাইতেছি না।
কি কন?
হ। আরেফিনের ফোন বন্ধ। বউমা ফোন ধরতেছে না।
হায় হায়! তাইলে কি হইব?
কি আর হইব। পরে আবার দেখবনে।
বউমার ফোনে আগে কি কতা কইছেন?
না। তা কই নাই।
তাইলে কেমনে পাইবেন? আপনের অচেনা নম্বর ধরব নাকি?
অচেনা নম্বর বইলা ফোনডাও ধরব না? না ধরলে না ধরলো!
জমিলা খাতুন হতাশার চোখে আলী আকবরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলের জন্য তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকেন তিনি। বিড় বিড় করে বলেন, মাবুদ গো; তুমি আমার ছেলেরে ভালো রাইখো। আমার সোনার মানিকরে তুমি সুস্থ রাইখো।
জমিলা খাতুনের চেহারা দেখে আলী আকবরও ভাবনায় পড়েন। তিনি বিড় বিড় করে বলেন, কয়দিন আগেও কতা হইল। কইল, ভালোই আছে। কোনো অসুবিধা নাই। মোবাইলডা কেন যে বন্ধ রাখল? বউমাও ফোনডা ধরতেছে না। বউমার কাছে কি আমার নম্বর আছে? কে জানে! অচেনা নাম্বার তো কেউ ধরতে চায় না।
আলী আকবর স্ত্রীর মাথায় হাত রাখেন। মন খারাপ কইরো না। আইজ যেমনেই হইক ছেলের খবর নিমু।
আবারও কাকটা ডানা ঝাপটে ঝাপটে ডাকে। কা কা কা কা!
দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছেন আলী আকবর ও জমিলা খাতুন। তাদের ধারণা, ছেলেটা কোনো বিপদে পড়েছে। তা না হলে নিশ্চয়ই সে যোগাযোগ করত। সে যোগাযোগ করছে না বলে আমরাও চুপচাপ বসে থাকব! না না! এভাবে ঘরে বসে থাকা যায় না!
আলী আকবর বললেন, আমি বরং ঢাকায় যাই। কি কও?
হ যান। ঢাকায় যান। বাসায় কেউ না কেউ তো থাকব!
হ। তা নিশ্চয়ই থাকব। ঠিকানাডা তোমার কাছে আছে নাহি?
আছে আছে। রাখছিলাম।
জমিলা খাতুন ধর্মীয় বইপুস্তকের ফাঁকে সাদা কাগজে লেখা একটা কাগজ বের করলেন। আলী আকবরের হাতে দিয়ে বললেন, দেহেন এইডা কি না?
হ আইডাই। রাহো। কাইল তাইলে রওয়ানা হই?
হ যান। দেরি কইরা লাভ নাই।
আলী আকবর ছেলের খোঁজে ঢাকায় আসেন। ছেলের বাসায় গিয়ে দেখেন দরজায় তালা ঝুলছে। বিস্ময়ের সঙ্গে বাসার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে ভাবেন, কি ব্যাপার! বাসার লোকজন মানে বউমা কই? বউ মা কি এই বাসায় থাহে না। আমাগোরে তো কিছুই কইলো না। এখন উপায় কি?
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আলী আকবর বাড়ির দারোয়ানের কাছে জানতে চান, আরেফিনের কোনো খবর জানো তোমরা?
আরেফিন স্যার আপনার কি হয়? দারোয়ান জানতে চাইল।
আমার ছেলে। ছেলে হয়।
সে তো বিদেশে!
হ জানি। চীন দেশে গেছে। কিন্তু বউমা? বউমা কই?
আপনার ছেলে যেদিন বিদেশে গেছে সেদিনই আপনার বউমা নিজ বাড়িতে চলে গেছে।
ওহ! বউমার ঠিকানাডা কি তোমার কাছে আছে? আমারে দিতে পারবা?
আমি কই পাব তার ঠিকানা? আমারে দেয় নাই। কেন, আপনি আপনার ছেলের শ্বশুর বাড়ি যান নাই?
দীঘনিশ্বাস ছেড়ে আলী আকবর বলেন, না রে বাবা!
দারোয়ান বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আলী আকবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলী আকবর মাথা নিচু করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি কি করবেন তা নিয়ে ভাবেন। ছেলের খোঁজ না নিয়েই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন! নাকি ঠিকানা জোগাড় করে ছেলের শ্বশুর বাড়িতে যাবেন! তিনি কোনো দিন ছেলের বড়লোক শ্বশুর বাড়ি যাননি। পরিচয়ও নেই ছেলের শ্বশুরের সঙ্গে। সেখানে গেলে তাকে যদি দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়! তখন কি হবে?
রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে আলী আকবর বাইরের দিকে পা বাড়ান।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/