ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৩
বিষাদ বসুধা
এতো লোকের অফিসে আসার দরকার নেই। যাদের অফিসে আসা খুব প্রয়োজন তারা ছাড়া সবাই ছুটিতে থাকবে। তালিকা বানান দ্রুত। তারপর আমি নোটিশ করে দিচ্ছি। তালিকা তৈরি করতে কতক্ষণ লাগবে বলেন তো?
আজকের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করব।
দেখেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলেন।
জি ম্যাম।
তাহলে যান। তালিকা তৈরি করেন। প্রয়োজনে আমি পুরো অফিসই বন্ধ রাখব। বুঝতে পারছেন?
জি ম্যাম।
এসময় টেলিফোনের রিং বাজে। মোহিনী ফোন ধরার জন্য হাত বাড়ায়। আর ইশারায় আবুল কালামকে চলে যেতে বলে। ফোনের রিসিভার কানে তুলতেই মোহসীন আলীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। মনে মনে তার কথাই সে ভাবছিল। মোহসীন আলী কিছু বলার আগেই মোহিনী বললেন, বাবা আমি তোমাকে ফোন করার কথাই চিন্তা করছিলাম।
তাই নাকি মা?
হ্যাঁ বাবা।
তাহলে আগে তোমার কথা শুনি। তারপর আমি বলছি।
তোমার অফিসে কি ছুটি দিয়ে দিয়েছ? নাকি এখনো খোলা রেখেছ?
সীমিত আকারে খোলা। অনেকে বাসায় বসে কাজ করছে। আবার অনেকে পুরোপুরি ছুটি কাটাচ্ছে।
ছুটিতে থাকলেও বেতন তো দিচ্ছ?
অবশ্যই। বেতন দেবো না কেন? এতে তো কারো হাত নেই; তাই না? প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে পারো। দুর্যোগে আমরা আমাদের সহকর্মীদের পাশে থাকব না!
আমি এটাই তোমার কাছ থেকে আশা করেছিলাম বাবা।
কি যে বলো! শোন, আমার ব্যবসার বয়স পঁচিশ বছর। তুমি তো জানো, অনেক ছোট অবস্থা থেকে আমি বড় হয়েছি। বাবা ছোট একটা জুটমিল রেখে গিয়েছিলেন। সেটার অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। আমার সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠান বড় হয়েছে। সুখ দুখে এরাই ছিল আমার সহযাত্রী। এখন একটা দুর্যোগ এসেছে। সারাবিশ্বই এই দুর্যোগের শিকার। বিপদের সময় সহকর্মীদের পাশে থাকাই যে আমাদের কর্তব্য মা।
জি বাবা। আমিও এটাই করেছি। কারো বেতন কাটা কিংবা বেতন ছাড়া ছুটিতে পাঠানোর কাজটি আমি করিনি।
কেন করবে? তুমি আমার মেয়ে না! শোন, এজন্য আমি তোমাকে ধন্যবাদ দেব না। তুমি আমার মেয়ে। আমাদের শরীরে মানুষের রক্ত; অমানুষের নয়। আমাদের সামনে কঠিন পরীক্ষার সময়। আমরা কতটা মানবিক তা এখনই প্রমাণিত হবে। সময়ের পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে।
জি বাবা। আমি তোমার সন্তান। এটা আমার অনেক গৌরবের।
ধন্যবাদ মা। প্রয়োজন মনে করলে অফিস বন্ধ করে দাও। সুযোগ আমাদের কাছে এসে ধরা দেবে। অবশ্যই ধরা দেবে। তুমি দেখ।
ঠিক আছে বাবা। আমি সেভাবেই করছি। আমার জন্য দোয়া করো বাবা।
অবশ্যই মা। আমি এখন রাখছি।
মোহসীন আলী ফোন রাখলেন। মোহিনীও ফোন রেখে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আসিফ আহমেদ মোহিনীর বন্ধু। তিনি পেশায় সাংবাদিক। একটি প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক। তাদের মধ্যে কালেভদ্রে কথাবার্তা হয়। দেশের পরিস্থিতি জানার জন্য মোহিনীই তাকে ফোন করেন। নানা বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। আজ আসিফই মোহিনীকে ফোন করেন। তার ফোন পেয়ে বিস্মিতই হন মোহিনী।
আরে আসিফ! কি মনে করে?
বিস্মিত হয়েছ মনে হচ্ছে?
বিস্মিত হবো না? তুমি কি কখনো নিজের থেকে আমাকে ফোন দিয়েছ? আমিই তোমাকে সময় সময় বিরক্ত করি।
কি যে বলো! আমি কি কখনো বিরক্ত হয়েছি?
তা হওনি। তবে তুমি খুব একটা ফোন করো না; এটা ঠিক।
তা মানছি। কেমন আছো বলো?
আমি ভালো আছি। তবে ব্যবসার অবস্থা তো বোঝই। খুবই সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের খবর বলো।
করোনায় সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছি আমরা।
কি রকম?
করোনার কারণে পত্রিকার সার্কুলেশনে তো ধস নেমেছে। বিজ্ঞাপনেও ভয়ংকর ধস। চিন্তাও করতে পারবে না কি পরিমাণ আয় কমেছে।
বলো কি!
আমাদের প্রতি মাসে এখন সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ বিজ্ঞাপন থেমে আয় মাত্র এক কোটি।
মাই গড!
তারপর শোন, সার্কুলেশন থেকে যে আয় হয় তা ট্রান্সপোর্ট খরচ বাবদ চলে যায়।
তার মানে পত্রিকা বিক্রি থেকে কোনো টাকা পাও না?
একদমই না। সারাদেশে পরিবহন খরচ বাবদ বিশাল একটা অংক চলে যায়। ফলে পত্রিকা বিক্রির টাকা ঘরে আসে না। আমি করোনাকালের কথা বলছি। করোনার আগে ভালো আসতো।
হুম। তার মানে আড়াই কোটি টাকা লোকসান?
তাহলে আর বলছি কি? আগে প্রতি মাসে আড়াই, তিন কোটি টাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আমরা পেতাম। এখন এক ইঞ্জি বিজ্ঞাপনও পাই না। অনলাইনে যা পাওয়া যাচ্ছে, তার পরিমাণ খুব কম। সুতরাং টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
বলো কি? এতো ভয়াবহ বিপদ!
হুম। কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক ছাঁটাইয়ের চাপ দিচ্ছে। কি যে করবো বুঝতে পারছি না।
ছাঁটাই! সে কি! এখন মানুষ এমনিতেই বিপদে আছে। এই বিপদের সময় ছাঁটাই করবে?
তোমরা কি করেছ বলো তো?
আমরা? আমরা ছাঁটাইয়ের চিন্তাও করিনি। ব্যবসা অনেক করেছি। এখন বেঁচে থাকার সময়। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর সময়। আমরা মুখে বলবো, মানুষ মানুষের জন্য। আর কাজ করবো তার উল্টোটা; তা হয় না। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি, তোমরা ছুটি কাটাও। অনেক সময় তো প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছ। প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক কিছু করেছ। তোমাদের শ্রম-ঘাম-মেধায় প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এবার ফ্যামিলিকে সময় দাও। প্রতিষ্ঠান তোমাদের পাশে থাকবে। কারো বেতন কাটা হবে না। চাকরিও যাবে না।
বাহ! অসাধারণ!
শোন, এখন একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে বলে তাদের ফেলে দেবো? এতে কি কর্মীদের কোনো হাত ছিল? নাকি তারা এই দুর্যোগ ডেকে এনেছে?
আসিফ আহমেদ চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। মোহিনী আবার বলতে শুরু করে। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুটি নীতি নিয়ে চলে। সততা আর মানবিকতা। আমার বাবাও তাই।
বলো কি!
হ্যাঁ।
তুমি সত্যিই অনেক মানবিক। আমি এখন রাখছি। পরে আবার কথা বলব।
আসিফ ফোন রাখার পর মোহিনী আর কাজে মন বসাতে পারলেন না। তিনি গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/