গল্প/ কুড়ি টাকার ন্যাতানো নোট!
সেই নোট হাতে নিলেই আমার নাকে পাঁট পচার গন্ধ আসে। গন্ধ আসার কারণ কুড়ি টাকার নোটজুড়ে জাঁক দেয়া পচা পাঁটের ছবি। আমি কুড়িটাকার সেই নোটের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আম্মা বললেন, 'কুড়িটাকা সবটাই খরচ কইরা আহিস না, টাকাপয়সা হাতে নিলেতো হুঁশ থাকেনা'।
আমি অবাক হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কুড়িটাকা! মাত্র কুড়িটাকা দিয়ে আম্মা কি বলছে এসব! একটা পিস্তলের দাম ৮টাকা, ১টাকা করে বারুদ। একটা বাঁশি দুইটাকা, একটা প্ল্যাস্টিকের চশমা ৫টাকা। তারপর? ট্রলারখান কেনা হবেনা! সে ভারি দাম, অতি দরাদরি করলেও ১৮টাকার নিচে কুলাবে না। কিন্তু বাদবাকি জিনিস কেনার পর আমার হাতে থাকবে সাকুল্যে ৪টাকা! তাহলে? তাহলে কি, সব বাদ দিয়ে শুধু ট্রলারখান কিনে ফেলব?'
এই ভাবনায় ডুবতে ডুবতে ঈদের জামাত লোকারণ্য হয়। আমি আনমনে হাটি। কঠিন হিসেব। কি কিনব? শুধু ট্রলার? না কি বাকি সব! শুধু ট্রলার কিনলে আমার যে আর কোমড়ে পিস্তল গুঁজে, চশমা চোখে, বাঁশি ফুইয়ে গাঁয়ের আর সবার সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা হবেনা! কিন্তু যদি এসব কিনি, তাহলে ট্রলার! ইশ, গতবার ঈদে পাশের বাড়ির ছালেক ট্রলার কিনেছিল। ওদের পুকুর নেই, আমাদের উঠোন পেড়িয়ে পুকুর। ও সেখানে ট্রলার ছেড়ে ছিল। টিনের ছোট্ট সেই ট্রলারের মাঝখানে কেরোসিনে ভেজানো সলতে, সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দিলেই ভটভট শব্দে ট্রলারখানা পুকুরজুড়ে ঘুরে বেরাল, ইশ! কী যে সুন্দর! কী যে সুন্দর!! আমার বুকের ভেতর ছটফট করে, প্রবল তেষ্টায় বুক ফেটে যায়! দম বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায়, আমি শ্বাস নিতে পারি না।
শেষঅবধি পিস্তল, বাঁশি আর চশমা কিনেই বাড়ি ফিরছি, কিন্তু মাঠের পাশে হরিহরণ চক্কোত্তির খোলা খেলনার দোকানের সামনে থেকে আর পা নড়াতে পারলামনা। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রলারগুলো দুমদাম করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! আমার বুকের ভেতর প্রবল আতংক, আর মাত্র ছটা! কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে, পাঁচ, চার, তিন, দুই...শেষ হয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে. ওহ! শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই জগতের অসহায়তম চোখজোড়া নিয়ে আমি তাকিয়ে আছি, তাকিয়েই আছি!
সব শেষ! একখানা ট্রলার মোটে বাকী! শেষঅবধি সেখানাও বিক্রি হয়ে গেল! আমি ছলছল চখের সকল আকুতি নিয়ে, কান্না নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। হরিহরন চক্কোত্তির ছেলে ট্রলারখানা কাগজে মুড়ে ক্রেতাকে দিল। টাকা নিল।
হরিহরন বনিক হঠাৎ বলল, ‘ও শংকর, ওইখান বেচিস না’।
শংকর বলল, ‘কেন’?
হরিহরন বনিক বলল, ‘ওইখান বেচা হইয়া গেছে’।
শংকর বলল, ‘কার কাছে বেচলা’?
হরিহরন বনিক আমাকে ডাকলেন, কাগজে মোড়ানো ট্রলারখানা আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘এই যে, এর কাছে’।
শংকর বলল, ‘এর কাছে? কখন বেচলা? কই, টাকা কই’?
হরিহরন বনিক বলল, ‘সব বেচায় টাকা লাগে না রে বাপ! সব যেমন টাকা দিয়া কেনন যায় না, তেমনে বেচনও যায় না...’
শংকর তার বাবার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না, আমিও না। আমরা দুজনই অবাক চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম হরিহরন বনিক নামের পৈতা গলায় চামড়া ভাঁজ হয়ে যাওয়া মানুষটার দিকে। সে আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না, কাজ করছে। তার অনেক কাজ! আমরা কিছুই বুঝিনি, কিছুই না।
তবে এতটুকুন ছোট্ট এক বুকের সবটুকু শূন্যতা ভাসিয়ে দিয়ে এক মহাশূন্যের সবটা আকাশ নিয়ে সেই কিশোর ছেলেটা সেদিন বাড়ি ফিরেছিল। সেই আকাশভর্তি এই জগতের সকল আনন্দ, উচ্ছ্বাস, প্রাপ্তি!
সেই প্রাপ্তির মূল্য এই জগতে নেই। কারণ, এই জগত সকল কিছুর মূল্য জানে না।
জানে না এই জগতের মানুষেরাও। তারা জানে না, কারো কারো জন্য একটা গোটা আকাশ কেনা কত সহজ, কত সহজ!