ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২০
দ্য ফার্স্ট ম্যান
শান্তশিষ্টভাবেই মামা সৈকতের দিকে ফিরত। কয়েকবার শ্বাস নিয়ে এমনভাবে ফিরতি পথ ধরত যেন সে শক্ত মাটির ওপর দিয়ে চলছে। তীরে ফিরে উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে জ্যাকের গা ডলে পরিষ্কার করে দিত এবং একদিকে সরে মুখ ঘুরিয়ে সশব্দে প্রস্রাব করত। তখনও তার হাসা চলতেই থাকত। শেষে ভালোভাবে কাজটা সারতে পারার জন্য নিজের মূত্রথলিকে ধন্যবাদ দিত এবং পেটের ওপরে চাপড় মারতে মারতে বলত, ভালো ভালো। এর সঙ্গে প্রকাশ পেত তার সকল সংবেদী আনন্দ, হতে পারে সে আনন্দের উৎস প্রস্রাব করে স্বস্তি পাওয়ার অথবা খেয়ে দেয়ে ভালো পুষ্টিলাভ করার। যেটাই হোক না কেন, সে উৎস যে তাকে নিষ্পাপ আনন্দ দিচ্ছে সে ব্যাপারটাই জোর দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা থাকত তার।
সে চাইত পরিবারের সবাই যেন তার আনন্দ যজ্ঞে যোগ দেয়। সে আনন্দের মুহূর্তে, বিশেষ করে খাবার ঘরে, নানি বাগড়া দিতে চেষ্টা করতেন এবং বলতেন এইসব কথা আগেই বলা হয়ে গেছে বহুবার, এমনকি তিনি নিজেও বলেছেন। তবে যদিও তিনি বলতেন, আমাদের খাওয়ার সময় ওসব বাদ দাও, তবু তিনি আর্নেস্ট মামার তরমুজ-অভিনয় মেনে নিতেন: মুত্রবর্ধক ওষুধ হিসেবে তরমুজের সুনামের কথা জানা ছিল মামার। তরমুজ তার খুব প্রিয় ছিল এবং সে তরমুজ খাওয়া শুরু করত হাসতে হাসতে আর দুষ্টুমিতে চোখ টিপত নানির দিকে, সঙ্গে যোগ হতো তার হাপুস হুপুস শব্দে তরমুজের পানি ছিটানোর কাজ। কয়েক কামড়েই সে পৌাঁছে যেত তরমুজের খোসার কাছাকাছি আর খাওয়ার সময় যেন গোটা একটা রূপকথার কাহিনী অভিনয় করে ফেলত: হাত দিয়ে দেখাতে থাকত কিভাবে তরমুজ তার মুখ থেকে মুত্র নির্গমনের অঙ্গ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।
মুখের বিচিত্র ভঙ্গি আর চোখ ঘোরানোর সঙ্গে মুখে বলত, ভালো, কী চমৎকার, একেবারে ধুয়ে দেয়; ভালো ভালো। তার প্রতি নজর না দিয়ে যেহেতু পারাই যেত না তাই সবাই হাসিতে ফেটে পড়ত। তার এই আদমসুলভ নিষ্পাপ আচণের সঙ্গে যোগ করতে হতো কয়েক ধরনের অসুস্থতার অতিরঞ্জিত ভান। ঠোঁট উল্টে দেখাতে চাইত, সে যেন তার অঙ্গ প্রতঙ্গের গোপন রহস্যগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সে বুঝাতে চাইত, শরীরের বিভিন্ন স্থানে সুচের খোঁচার মতো ব্যথা অনুভব করছে, কিংবা একটা পিণ্ড তার শরীরে ঘোরা ফেরা করছে। পরবর্তীতে জ্যাক যখন লিসিতে পড়াশোনা করছে তখনকার দিনের কথা মনে আছে: মামা মনে করত, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক বিষয় আছে যেটা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। সে বিশ্বাস থেকে মামা তার পিঠের নিচে এবং কোমরের ওপরের দিকে দেখিয়ে জ্যাককে বলত, এই যে এখানে, এখানে কেমন যেন টান লাগছে। জ্যাক জিজ্ঞেস করত, এখানে ব্যথা? আসলে ওখানে কিছু হয়নি।
মামা স্বস্তি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ছোট ছোট পদক্ষেপে তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য পাড়ার কোনো ক্যাফের দিকে রওনা হয়ে যেত। রাতের খাবার খেতে মামাকে ডাকার জন্য সে ওই করাতের ঘুণের গন্ধ আর কাঠের আসবাবপত্র সজ্জিত রেস্তোরায় বহুবার গিয়েছে। জ্যাক দেখেছে মামা তার বন্ধুদের আড্ডায় দেদারসে কথা বলে যাচ্ছে আর বন্ধুরা হো হো করে হাসছে। তাদের হাসির মধ্যে কোনো রকম বিদ্রুপ থাকত না; আর্নেস্টের সোজাসাপটা উদারতার কারণে সবাই তাকে খুব ভালোবাসত।
এই বিষয়টা জ্যাক আরো ভালো করে বুঝতে পারত মামা যখন তার বন্ধুদের সঙ্গে শিকার অভিযানে তাকেও সঙ্গে নিত। তার বন্ধুদের সবাই তার মতোই টব, পিপে ইত্যাদি নির্মাণের কাজ, রেলওয়ের কাজ কিংবা বন্দরের কাজ করত। শিকারে যাওয়ার দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো। মামাকে জাগানোর দায়িত্ব থাকত জ্যাকের ওপর। কোনো অ্যালার্মের শব্দেই তার ঘুম ভাঙত না। অ্যালার্মের শব্দে জ্যাক জেগে ওঠার সময় তার ভাই বিছানায় পাশ ফিরে শুতে শুতে গজ গজ করে বিরক্তি প্রকাশ করত। আরেক বিছানায় মা ঘুমের মধ্যেই একটুখানি নড়াচড়া করে চুপ হয়ে থাকতেন। বিছানা ছেড়ে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে দুই বিছানার মাঝখানে রাতের টেবিলের ওপরে রাখা কেরোসিন বাতিটা জ্বালাত জ্যাক। (ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটা সিঙ্গেল বিছানা–সেখানে মা ঘুমাতেন এবং একটা ডাবল বিছানা–সেখানে ঘুমাত জ্যাক এবং তার ভাই; দুই বিছানার মাঝখানে ছিল রাতের টেবিল; আর টেবিল বরাবর আয়নাঅলা একটা আলমারি। মায়ের বিছানার গোড়ার দিকে উঠোনমুখি একটা জানালা। জানালাটার নিচে হাতে ফুলতোলা কম্বলে ঢাকা একটা বেতের ট্রাঙ্ক। জ্যাক যখন খুব ছোট ছিল তখন জানালার ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য হাঁটু মুড়ে ট্রাঙ্কের ওপর উঠে দাঁড়াত।)
তারপর খাবার ঘরে গিয়ে মামাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিত। মামা ভয়ে চিৎকার দিয়ে মুখের ওপরে ধরা বাতিটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাত এবং শেষে ধাতস্থ হতে পারত। দুজনই বাইরে যাওয়ার পোশাক পরে নিত। রাতে খেয়ে বেঁচে যাওয়া কফি গরম করত জ্যাক। আর মামা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা বস্তায় প্যাকেট করতে থাকত: তার মধ্যে থাকত এক খণ্ড পনির, সাব্রাসাডা সস, লবণ মরিচ মাখানো কয়েক টুকরো টমেটো আর আধখানা রুটি, তার মাঝখানে ভাগ করে নানির বানানো ওমলেট ঢুকিয়ে দেওয়া থাকত। তারপর মামা দোনালা ছটকা-বন্দুক এবং কারতুজ শেষ বারের মতো পরীক্ষা করে নিত।
ওইসব অস্ত্রের ওপর অবশ্য আগের রাতেই মোটামুটি একটা আনুষ্ঠানিক যজ্ঞ শেষ করে রাখা হতো। আগের রাতেই খাবারের পর টেবিল পুরষ্কার করে ওপরে ঝোলানো বতির আলোয় নিজে টেবিলের একপাশে বসে সামনে বন্দুকের খুলে ফেলা অংশগুলোতে যত্নের সঙ্গে গ্রিজ মাখাত মামা। টেবিলের আরেক পাশে বসে জ্যাক নিজের কাজের পালার জন্য অপেক্ষা করত। তেমনি অপেক্ষা করত তাদের কুকুর ব্রিলিয়ান্ট। দীর্ঘ লোমঅলা মিশ্র রঙের অতিশয় শান্ত স্বভাবের একটা কুকুর, একটা মাছিকেও আঘাত করতে পারত না। তার প্রমাণ অনেক আছে: যদি কখনও কোনো উড়ন্ত মাছি তার হা করা মুখের ভেতর আটকে যেত তাহলে বিরক্ত মুখভঙ্গির সঙ্গে চোয়াল আর লম্বা জিহ্বা বের করে থুথু ফেলার মতো করে ফেলে দিত। আর্নেস্ট এবং কুকুরটা ছিল একাত্মা; দুজনের মধ্যে ছিল চমৎকার বোঝাপড়া। আর্নেস্ট এবং কুকুরটাকে যুগল না ভেবে উপায় ছিল না। যারা কোনোদিন কুকুর সম্পর্কে ভালো করে জানেনি কিংবা কুকুরকে ভালোবাসেনি শুধু তাদের পক্ষেই এই যুগলবন্দি দস্তিকে হাস্যকর মনে করা সম্ভব ছিল। কুকুরটা মনিবের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত আনুগত্য আর ভালোবাসা দিয়ে। আর মনিব কুকুরকে ভালোবাসা দিত। তাদের জীবন যাপন ছিল এক সঙ্গে এবং একজন আরেকজনকে কখনওই ফেলে কোথাও যেত না।
দুজনের ঘুম হতো এক সঙ্গে, এক জায়গায়: মনিব খাবার ঘরের একটা মোটা বিছানার ওপরে আর কুকুরটা তার বিছানার পাশে ছোট একটা কম্বলে। দুজনে কাজে যেতো এক সঙ্গে: আর্নেস্টের কর্মস্থলে শুধু তার কুকুরের জন্য র্যাদা দিয়ে চেঁছে একটা চাঁচনি কাঠের শোবার জায়গা তৈরি করা হয়েছিল একটা বেঞ্চের তলায়। ক্যাফেতেও যেত এক সঙ্গে: মনিবের কাজকর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কুকুরটা তার দুপায়ের মাঝখানে ধৈর্যসহকারে বসে থাকত। দুজনের কথাবার্তা হতো ধনাত্বক শব্দে এবং একজন আরেকজনের গায়ের গন্ধও উপভোগ করত। কেউ কোনোদিন আর্নেস্টকে বলতে পারেনি, তার কুকুরটাকে খুব কম ধোয়ার কারণে গা থেকে কড়া দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, বিশেষ করে বৃষ্টির পরে। কুকুরের কম্পমান কানের ভেতরে আদরের ভঙ্গিতে মুখ নিয়ে শুকে দেখে আর্নেস্ট কলত, ওর গন্ধ নেই।
চলবে..
এসএ/