ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৯
দ্য ফার্স্ট ম্যান
সৈকতে যেতে ভেড়ার পথ নামক একটা এলাকা পর হতে হতো। কারণ আসলেই আলজিয়ার্সের মাইসন কারি বাজারে যাওয়া আসার পথে অনেক ভেড়া ওই পথে যাতায়াত করত। আসলে সেটা ছিল একটা পার্শ্বিক রাস্তা। সমুদ্র আর শহরকে বিভাজনকারী এই রাস্তাটা এম্পিথিয়েটারের মতো পাহাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাস্তা আর সমুদ্রের মাঝে ছিল কারখানা, ইটের ভাটা, গ্যাসের কারখানা; রাস্তাটা কাদামাটি কিংবা চুনাগুড়ার আস্তরণে ঢাকা বালিময় এলাকা দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল অন্য সবকিছু থেকে। সেখানে লোহা আর কাঠের ছাঁট সাদায় পরিণত হতো। সাবলেতেস সৈকতে পৌঁছতে হলে ওই ঊষঢ় এলাকাটা পার হতে হতো। সৈকতের বালির মধ্যে থাকত ময়লা আবর্জনা। আর প্রথম ঢেউয়ের পানি সব সময় পরিষ্কার থাকত না। ডান দিকের গণগোসলখানায় কেবিন ছিল। রণপায়ের ওপর স্থাপিত কাঠের বাক্সের আকারের হলে ছুটির দিনে নাচার ব্যবস্থাও থাকত।
জমজমাট মৌসুমে ফ্রেঞ্চ-ফ্রাইঅলা সৈকতে স্টোভ জ্বালাত। জ্যাকদের ছোট দলের কারো কাছে বেশিরভাগ সময়ই এক ঠোঙা আলুভাজা খাওয়ার পয়সাও থাকত না। যদি কখনও তাদের কারো কাছে ভাজা কেনার পয়সা থাকত তাহলে সে ঠোঙা হাতে গম্ভীর চালে সোজা সৈকতের দিকে হাঁটা দিত। পেছনে বাকিরা তাকে সমীহের সঙ্গে অনুসরণ করত। সমুদ্রের ধারে আটকে থাকা ভাঙাচোরা পুরনো কোনো বজরার ছায়ায় পা বিছিয়ে বসে এক হাতে ঠোঙার নিচের অংশ অন্য হাতে ঠোঙার ওপরের অংশ ধরে থাকত যাতে একটা মচমচে টুকরোও যেন পড়ে না যায়। তাদের মধ্যে নিয়ম ছিল ঠোঙার মালিক সঙ্গীদের প্রত্যেককে সুগ্রাস হিসেবে একটা করে টুকরো দেবে এবং তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে গরম গরম ওই এক টুকরো খেয়ে কড়া তেলের স্বাদে আহাউহু করে উঠবে। ঠোঙার ভাগ্যবান মালিক বাকি টুকরোগুলো আয়েশ করে খাবে এবং বাকিরা তার খাওয়া দেখবে। টুকরোগুলো শেষ হয়ে গেলে ঠোঙার তলায় পড়ে থাকা আলু ভাজার গুঁড়োগুলো খাওয়ার জন্য সঙ্গীরা পেটুক মালিকের কাছে অনুনয় বিনয় করত। ঠোঙার মালিক কিপটে জাঁ ছাড়া অন্য কেউ হলে সাধারণত ঠোঙাটা ছিড়ে ভেতরের অংশটা বাইরে এনে প্রত্যেককে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একেকটা টুকরো খেতে দিত। তখন সবার মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কে আগে নেবে, কে বড় টুকরোটা নেবে।
খাওয়া-পর্ব শেষ হয়ে গেলে আনন্দ আর হতাশার কথাও তারা ভুলে যেত। এরপর সৈকতের পশ্চিম প্রান্তের দিকে দৌড় শুরু করত সবাই। পশ্চিম প্রান্তে ছিল ইটসুরকির একটা ভাঙা কাঠামো। হয়তো কোনো এক সময়কার বাংলোর ভিত্তি ছিল সেটা। ওই কাঠামোটার কাছে না পৌঁছনো পর্যন্ত তাদের দৌড় চলতেই থাকত। কাঠামোটার আড়ালে সবাই পরনের কাপড় খুলে ফেলত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবাই দিগম্বর হয়ে যেত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সবাই পানিতে নেমে আনাড়ি ভঙ্গিতে সাঁতার কাটত, চিৎকার ছুড়ে দিত, মুখ থেকে কুলি করে পানি ছিটিয়ে দিত, কে কত গভীরে ডুব দিতে পারে কিংবা কে সবচেয়ে বেশিক্ষণ পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে তার বাজি ধরত।
সমুদ্র শান্ত এবং উষ্ণ; তাদের ভেজা মাথার ওপরে সূর্যের হালকা আলো পড়ত আর আলোর ঔজ্জ্বল্য তাদের কচি শরীরের ওপর পড়ার ফলে থেকে থেকে আনন্দের চিৎকার ছুড়ে দিত তারা। জীবনের ওপরে এবং সমুদ্রের ওপরে তারা রাজত্ব করত তখন। অভিজাত লোকদের মতো তারা মনে করত, তাদের সম্পদের কোনো সীমা নেই। বেপরোয়ভাবে তারা পৃথিবীর এই দানের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উপহার উপভোগ করত।
সমুদ্র আর সৈকতের মাঝে ওঠা নামা করতে করতে তারা সময়ের কথা ভুলে যেত। বালির ওপরে উঠে আসলে তাদের শরীর আঠালো মনে হতো আর সমুদের পানিতে নেমে আবার সাদা পোশাকের মতো বালি ধুয়ে ফেলত। তারা এরপর দৌড়তে থাকত এবং দৌড়ের সঙ্গে তাদের চিৎকার আশপাশের কারখানাগুলোর মধ্যে ডুবে যেতে থাকত। তখন আকাশ ফাঁকা হয়ে যেত এবং দিনের তপ্ত হালকা কুয়াশা উঠে গেলে চারপাশ পরিষ্কার হয়ে উঠত, তারপর সবুজাভ আভা ছড়িয়ে পড়ত। আলো কমে আসলে উপসাগরের অন্য পাশটা তখনও মনে হতো কুয়াশায় ঢাকা। বাড়িঘর আর শহরের ঢালু বিস্তার আরও সুস্পষ্ট মনে হতো। তখনও দিন; তবু আফ্রিকার সংক্ষিপ্ত গোধূলির প্রস্তুতি হিসেবে বাতি জ্বালানো হতো তখনই।
সবার আগে সাধারণত পিয়েরে সংকেত দিত, দেরি হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, যতদূর সম্ভব দ্রুত বিদায়। অন্যদের কথা মোটেও না ভেবে যোসেফ এবং জাঁর সঙ্গে বাড়ির দিকে দৌড়তে থাকত জ্যাক। সৈকতের সীমানার বাইরে না আসা পর্যন্ত তারা ঘোড়ার দুলকি দৌড়ের গতিতে চলতে থাকত। তাদের জানা ছিল, যোসেফের মায়ের হাত ভালোই চলে; জ্যাকের নানির হাতও। দ্রুত নেমে আসা রাতের মধ্যে তারা দৌড়ত। গ্যাসের প্রথম আলো জ্বলে উঠলে তাদের আত্মা চমকে উঠত। তাদের সামনে থেকে ট্রলি বাসগুলো আলো জ্বালিয়ে দূরে বিলীন হয়ে যেত। আরও দ্রুত দৌড়তে দৌড়তে তারা দেখতে পেত, রাত ইতোমধ্যে জেঁকে বসেছে। শেষে দরজার কাছে এসে জ্যাক ওদের থেকে আলাদা হয়ে যেত বিদায় না জানিয়েই।
এ রকম সব সন্ধ্যায় জ্যাক পুতিগন্ধময় সিঁড়ির কাছে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে থাকত যাতে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু অপেক্ষা করতে পারত না। আতঙ্কে বরং হৃদস্পন্দন আরও বেড়ে যেত। তিন লাফে সিঁড়ির মাঝখানে, টয়লেটের দিকে যাওয়ার দরজা দিয়ে সোজা মেঝের দিকে পা বাড়াত এবং দরজা খুলত। খাবার ঘরের কোণায় আলো জ্বলত। থালাবাসনের সঙ্গে ঘষা খাওয়া চামচের ক্যাচক্যাচানি শোনা যেত। আরও সামনে প্রবেশ করে দেখত, তার আধো বোবা মামা সশব্দে সুপ পান করে যাচ্ছে। মায়ের বয়স তখনও অল্প ছিল। ছড়িয়ে পড়া বাদামী চুলের আড়ালে মায়ের শান্ত চাহনি চোখে পড়ত। মা কথা বলা শুরু করতেন, তুই ভালো করেই জানিস....।
কিন্তু জ্যাক তখন নানির শুধু পেছন পাশটা দেখেছে যখন তিনি তার মেয়ের কথার মাঝে নিজেই কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন। কালো পোশাকে নানির শরীর ঋজু; মুখাবয়ব কাঠিন্যে ভরা; সোজাসুজি কড়া চোখে তাকিয়ে নানি জিজ্ঞেস করতেন, কোথায় ছিলি?
–পিয়েরে আমার পাটীগণিতের বাড়ির কাজ দেখিয়ে দিচ্ছিল।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নানি তার কাছে এসে জ্যাকের চুল শুঁকতেন। তারপর জ্যাকের পায়ের দিকে হাত দিয়ে দেখতেন–বালির আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে গোড়ালি।
–তুই সৈকতে গিয়েছিলি।
মামা কোনো রকমে বলে উঠতেন, তাহলে তুমি মিথ্যে বলছ।
জ্যাকের পিছন দিকে এগিয়ে গিয়ে নানি দরজার পেছন থেকে কড়া চাবুকটা নিয়ে আসেন। পায়ের নিচের দিকে এবং পাছায় সপাং সপাং বাড়ি মারেন গোটা চারেক। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে জ্যাক। একটু পরে মুখ আর গলা অশ্রুতে ভরে গেলেও মামার দয়াপরবশ হয়ে দেওয়া সুপের প্লেট সামনে নিয়ে জ্যাক আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখ বেয়ে যেন অশ্রু না নামে। নানির দিকে এক নজর তাকিয়ে মা তার কাছে উঠে আসেন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যাক ভেতর থেকে অনুভব করতে থাকে, এই তার একমাত্র প্রিয় মুখ। মা বলেন, তোর সুপ খেয়ে ফেল। আর কিছু বলবে না। আর কিছু বলবে না। জ্যাক তখন সব প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে কান্নায় ভাসতে থাকত।
জ্যাক করমারি জেগে উঠেছে। ঘুলঘুলির তামার ওপরে আর সূর্যের আলো পড়ছে না। সূর্য দিগন্তে অস্ত গেছে। কেবিনের কাঠের আচ্ছাদনের ওপর আলো পড়ছে। পোশাক পরে নিয়ে জ্যাক ডেকের দিকে পা বাড়াতে থাকে। রাত শেষ হলেই আলজিয়ার্সের দেখা পাবে সে।
(চলবে)
এসএ/