ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১৭
অঘ্রানের অন্ধকারে
আজ শাবিনের জন্মদিন। রিহ্যাব থেকে আসার পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে। তাকে দেখলে মনেই হয় না সে কোনোদিন মাদক নিয়েছে। তুরির দিন কাটছে আনন্দে।
শাবিনের ইচ্ছে হয়েছে তার জন্মদিন উদযাপন করবে জাঁকজমক করে। তুরি ব্যবস্থা করে ফেলেছে। শাবিনের জন্মদিন বিশাল ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। বাড়ির ছাদে চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে গান বাজছে। আমন্ত্রিত হয়ে যারা এসেছে তারা দেদার আনন্দ করছে। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে ভালো। প্রচুর জুস, ফল আর স্ন্যাকস দেওয়া হয়েছে। সকলে ইচ্ছেমতো খাচ্ছে।
শাবিনের বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। পুন্নি এসেছে ঝলমলে পোশাক পরে। তাকে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো দেখাচ্ছে। সে চারপাশ আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিয়েতে তুরি তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত দিতে পারেনি। তার বিয়েতে কোনো আয়োজন হয়নি। দুজনের সিগনেচারের সঙ্গে কোনোরকমে শুধু কবুল বলা হয়েছিল। শাবিনের জন্মদিনে তুরি তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। দাওয়াত পেয়ে তারা প্রায় সকলেই এসেছে। তুরির সুখী চেহারা দেখে তাদের ভালো লাগছে।
শাবিন এসে তুরির দুহাত জড়িয়ে ধরল। ছাদে প্রচুর মানুষ। শাবিনের এমন আকস্মিক আচরণে তুরি লজ্জা পেয়েছে। সে ডানেবাঁয়ে তাকাল। তুরির কানের কাছে মুখ এনে শাবিন ফিসফিস করে মিহি গলায় বলল, তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।
তুমি পাগল একটা।
শাবিনের গলায় মহুয়ার মাদকতা। সে ওম-ওম গলায় আবার বলল, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর কোনোদিন কষ্ট দেব না।
শাবিনের কথা গানের আওয়াজের নিচে তলিয়ে গেল। তুরি বলল, আমার সঙ্গে আসবে?
তুরি চোখ দিয়ে ইশারা করল। শাবিন তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল।
তুরি হাঁটছে। শাবিন হাঁটছে তার পেছনে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে ওরা বাসায় ঢুকল। বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তুরি। শাবিনও দাঁড়িয়ে পড়ল।
বেডরুমে তুরির বান্ধবীরা হল্লা করছে। তুরি তাদের বলল, তোরা ছাদে যাবি একটু? গানবাজনা হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। ওখানে যা।
তুরির বান্ধবীরা ঘাড় কাত করে শাবিনকে দেখল। তারা তুরির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় ওদের চোখে তুরি দুষ্টুমির হাসি দেখেছে।
শাবিনকে নিয়ে তুরি ঘরে ঢুকে পড়ল। দরজার পাল্লা টেনে বন্ধ করে দিলো। শাবিনকে জড়িয়ে ধরে কাতর গলায় বলল, আদর করো। তোমার আদর পেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
শাবিন দুহাত বাড়িয়ে তুরিকে বুকের ভেতর টেনে নিয়েছে। তুরির ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। সেই ঠোঁটে অদ্ভুত উষ্ণতা। এমন উষ্ণতা শাবিন আগে কখনো অনুভব করেনি। তুরির কাঁধের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়েছে। শাবিন গভীর আবেগে তুরির ঠোঁট নিজের দুই ঠোঁটের ভেতর নিয়ে চেপে ধরল।
তুরির শরীর কাঁপছে। তিরতির করে কাঁপছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার খোলা কাঁধে শাবিনের ঠোঁট। গরম নিশ্বাস পড়ছে। অস্থির হয়ে গেছে তুরি। বিছানার কাছে সরে এসে শরীর ছেড়ে দিলো। কাত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। গোঙাতে গোঙাতে বলল, আমাকে তুমি আদর করো। আদর করতে করতে মেরে ফেলো।
শাবিন আচমকা থেমে গেল। শীতল গলায় বলল, ছাদে যাও। তোমার বান্ধবীরা অপেক্ষা করছে।
আদর করবে না?
হুট করে কেউ চলে আসবে। বাড়িভরতি মানুষ।
তাহলে রাতে আদর করবে বলো?
শাবিন গভীর চোখে তুরির দিকে তাকিয়ে থাকল। তুরির মন অমনি কেমন করে উঠল। সে শাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। শাবিন উবু হয়ে তুরির ঠোঁটে, দুই চোখে, গালে, গলায়, কপালে, কাঁধে, কানে আলতো করে চুমু দিলো।
তুরি উঠে দরজা খুলে চলে গেল। ছাদে যাওয়ার সিঁড়িগুলো লাফিয়ে উঠেছে। সে যেন পাখি। উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে।
গানের আওয়াজ তীব্র হয়েছে। ছোটো ছেলেমেয়েরা লাফালাফি করছে। বড়োরা হুল্লোড় করছে। তুমুল আনন্দে উথলে উঠেছে সময়।
টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। হইচই করে সকলে খেতে বসেছে। তুরি ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। শাবিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শাবিনের বন্ধুরা খেতে বসেছে। সেখানে শাবিন নেই।
পুরো ছাদ খুঁজে এসেছে তুরি। শাবিন কোথাও নেই। তুরি দৌড় দিয়ে বাসায় গেল। বেডরুমের দরজা ভেজানো। কেন জানি তুরির বুক ধ্বক করে উঠল। তার এমন কেন লাগছে সে বুঝতে পারল না।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে তুরি। শাবিন শুয়ে আছে বিছানায়। তার মাথা একপাশে হেলে আছে। অসাড় হাত পড়ে আছে বিছানা থেকে বাইরে। শাবিনের মাথার কাছে পানির গøাস আর ওষুধের স্ট্রিপ। তুরি সেই ট্যাবলেটের স্ট্রিপ হাতে নিয়ে ওষুধের নাম পড়ল। বারবিট। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। চল্লিশটা ট্যাবলেট সে খেয়েছে। শাবিন অনেক আগেই মারা গেছে।
তুরি দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। শাবিনের নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। তুরি কী করবে বুঝতে পারছে না। দুই পা ভীষণ ভারী লাগছে। সে নড়তে পারছে না। তার চোখ শুকনো খটখটে। সে কাঁদতে চাইছে। কান্না আসছে না।
তুরি দুই হাঁটু মুড়ে ধপাস করে বসে পড়ল শাবিনের মাথার কাছে। শাবিনের হাত তার কোলে। শাবিন যেন ঘুমাচ্ছে। পরম প্রশান্তির ঘুম।
তুরি সামনে ঝুঁকে এলো। শাবিনের শরীর শক্ত হয়ে আছে। তুরি তার ভারী দুহাত তুলে আনল। সে শাবিনের মাথা দুপাশ থেকে চেপে ধরেছে। অমনি গড়িয়ে এসে শাবিনের মাথা ঝুঁকে পড়ল তুরির বুকের ভেতর।
তুরি কাঁদছে। শাবিনের মাথা বুকের ভেতর নিয়ে কান্নায় তার বুক দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। সে কাঁদছে হুহু করে। তার দুই চোখ ভিজিয়ে চোখের পানি ঝরে পড়ছে শাবিনের কপালে।
(চলবে...)