ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১৩
অঘ্রানের অন্ধকারে
অফিসে ঢুকতেই ধাক্কা খেয়েছি । একজন ছেলে অফিস গেটের সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির দিকে ভালো করে তাকালাম। পরনে জিনসের প্যান্ট। গায়ে ঢোলা শার্ট। পায়ে কমলা রঙের স্নিকার। শুকনো লিকলিকে চেহারা। দুই গাল বসে গর্ত হয়ে গেছে। তাতে গালের দুপাশের হাড় খানিকটা বেখাপ্পা রকমের উঁচু দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বড়ো বড়ো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তবে তা কয়েকদিন শেভ না করার জন্য নাকি ফ্যাশন বোঝা যাচ্ছে না। এখন তরুণরা ফ্যাশন করে মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রাখে। সে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়েছে। ছেলেটির ভেতর অভিজাত ভাব আছে।
ছেলেটি বলল, আমি শাবিন। তুরি আমার স্ত্রী।
তাকে চিনতে পারলাম। অবাক হলাম না। সে আমার কাছে আসবে অনুমান করেছিলাম। বললাম, আমার সঙ্গে এসো।
আপনার সাথে কথা আছে।
তোমাকে আসতে বলেছি।
জানি না শাবিন আমার কাছে কেন এসেছে। সে যেকোনো অস্বত্তিকর অবস্থা তৈরি করে ফেলতে পারে। তাকে অফিসের ভেতর নিয়ে যেতে হবে। তার কথা শোনা দরকার।
শাবিনকে বিভ্রান্ত দেখোচ্ছে। সে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছে। শাবিন হয়তো ভেবেছিল আমি তাকে গুরুত্ব দেব না। কিংবা না চেনার ভান করব। অফিসের গেট থেকে বিদায় করে দেব। সেসব কিছুই করিনি। তাকে সঙ্গে যেতে বলেছি ভেতরে। শাবিন আমার সঙ্গে আমার অফিসরুমের দিকে রওনা হলো।
ঘরে ঢুকে এসি অন করলাম। এসির টেম্পারেচার দিয়েছি ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসির পাখা তিনটা চালু রেখেছি। আমি চাইছি ঘর দ্রুত হিম ঠান্ডা হয়ে যাক। হিম ঠান্ডা পরিবেশে শাবিনের সঙ্গে কথা বলব।
ইউসুফকে ডেকে বেশি চিনি আর দুধ দিয়ে শাবিনের জন্য চা দিতে বলেছি।
শাবিন বলল, বাজারে আপনার বইয়ের কাটতি ভালো। পাবলিক বেশ খায়।
গল্প-উপন্যাস কোনো খাদ্যদ্রব্য না যে সেটা খাওয়া যাবে।
মিডলক্লাস সস্তা সেন্টিমেন্ট নিয়ে গল্প লেখেন। কায়নাত খান এখন একজন জনপ্রিয় লেখক। দেশের গন্ডিতে আপনার জনপ্রিয়তার কাছাকাছি কেউ আসতে পারেনি। আপনি হয়তো হারুকি মুরাকামি কিংবা জন গ্রিসামের জনপ্রিয়তাকে ছুঁতে চাইছেন। তাদের মতো করে লেখেন। আপনি কি জানেন, জনপ্রিয়তা সস্তার খুব কাছাকাছি। আপনি সস্তা হয়ে গেছেন কায়নাত খান, সেটা বুঝতে পারেননি।
হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছি না শাবিন কী বলতে চাইছে। নিজেকে শান্ত রাখলাম। স্থির চোখে শাবিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কি আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছ?
আপনার লেখা এক একটা বই হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা রয়্যালটি পান আপনি।
তো?
আমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আপনারা গল্প লিখছেন। সেই গল্প বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামাবেন। আমাকে কিছু ভাগ দেন।
মানে?
হাতে টাকাপয়সা নেই। কিছু টাকা দেন।
তোমার জীবন নিয়ে গল্প লেখা হচ্ছে না। তুরি তার নোটবুকে নিজের কিছু কথা লিখেছে।
তুরির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? গল্পকার বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে আমার বউকে নিয়ে ঢলাঢলি করছেন। ব্যাপারটা পাবলিক ভালোভাবে নেবে না, কায়নাত খান।
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। থাবড়ে এই ছেলের দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঠিক করেছি রাগব না। শাবিনকে বোঝার চেষ্টা করলাম। সে উপন্যাসের ভালো চরিত্র হতে পারে। তাকে দরকার আছে।
বললাম, তোমার বউকে নিজের কাছে রাখো। তারসঙ্গে ঘুরতে যাও। ভালোবাসা দাও।
আমাকে কিছু টাকা দেন। আমি চলে যাচ্ছি। তারসঙ্গে আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন। কিছু বলব না।
ইউসুফ কফি নিয়ে এসেছে। সঙ্গে স্যান্ডউইচ।
কফি আর স্যান্ডউইচ রেখে ইউসুফ চলে গেল।
শাবিন আরাম করে কফি খাচ্ছে। কফি খেয়ে সে মজা পাচ্ছে। কফিতে চুমুক দিয়ে শাবিন বলল, আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি আর কোনোদিন আসব না। তুরি ভালো মেয়ে। সে সুন্দর লেখে। লেখার হাত আমারও ছিল। কবিতা লিখতাম, গান লিখেছি, গল্প-সব। ভালো লেখা, মন্দ লেখা বুঝতে পারি। তুরি আমাকে তার লেখা পড়ে শুনিয়েছে। পুন্নির কথা শুনে রাগ করেনি। আই লাভ পুন্নি। আই লাভ তুরি। আই লাভ বোথ অব দেম।
শাবিন হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নাকের সর্দি মুছল। তার দিকে টিস্যুবক্স এগিয়ে দিলাম। সে বক্স থেকে টিস্যু নেয়নি। আবার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নাকের সর্দি মুছে হাত প্যান্টে ঘষে নিয়েছে।
শাবিনের শরীর থিরথির করে কাঁপছে। কফি পুরোটুকু শেষ করতে পারেনি। তার হাতপা শক্ত হয়ে এসেছে। সে হাত মুচড়ে বলল, টাকা দেন। ধার নিচ্ছি। দিয়ে দেব।
বললাম, তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলে বারান্দায় গিয়ে খেতে পারো।
আমার কাছে সিগারেট নেই।
বারান্দায় এসো।
শাবিন বারান্দায় এলো। তার হাতে সিগারেট দিয়ে বললাম, তুমি এখন পরপর দুটো সিগারেট খাবে।
আমার শরীর খারাপ লাগছে। সিগারেটে হবে না। পাউডারের ব্যবস্থা লাগবে। পুন্নি ব্যবস্থা করে ফেলেছে। গাজী শালা এখন বলছে বাকি দেবে না। পুন্নি তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। টাকা দেন। গাজী শালার পুটকির ভেতর টাকা ভরে দিয়ে পুন্নিকে ছাড়িয়ে আনি।
সিগারেট জালাও।
শাবিন সিগারেট জালিয়েছে। সিগারেটে ঘনঘন দুটো টান দিয়ে বলল, শালার বাপ একটা বাইনচোত। আমার বয়স তখন আঠারো বছর। সব বুঝি। আমার বাপ সারাদিন আমার মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। মা চুপ করে থাকে। একদিন যেই কথা বলেছে অমনি ঠাস ঠাস করে তাকে চড় মারতে থাকল। আমার মনে হলো বাপকে খুন করে ফেলি। মা আমাকে কিছুই করতে দিলো না। কী হলো? মাকে দিয়ে ডিভোর্স নিল। মাকে বলল তাতে আমার ভালো হবে। আমার ভালোর জন্য বাইনচোত বাপ যা বলল মা তাই শুনল। মা আমার বাপকে ডিভোর্স দিলো।
শাবিন একটা সিগারেট থেকে আরেকটা সিগারেট জালাল। তার নাক থেকে সর্দি ঝরছে। সে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এক হাত দিয়ে মাঝেমাঝে পেট চেপে ধরছে। তার পেট ব্যথা শুরু হয়েছে।
শাবিন বলল, প্রথম প্রথম কিছুদিন টাকা দিত। আমি গিয়ে টাকা নিয়ে আসতাম। তারপর সে তার ঠিকানা বদলে ফেলল। এখন তাকে আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। একবার তাকে খুঁজে পেলে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলব, এই ইঞ্জিনিয়ার মারুফ হোসেন আমার বাবা। সে আমার মাকে মেরে তার কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়েছে। এখন কারসঙ্গে থাকে আমরা জানি না।
শাবিনের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে। সে সিগারেট ফেলে দিয়ে দুহাত দিয়ে পেট চেপে ধরল। তার হেঁচকি শুরু হয়েছে। পেট চেপে ধরে হিক্কা তুলতে তুলতে শাবিন অফিস থেকে বের হয়ে গেল। আমার ধারণা শাবিন যাচ্ছে পুন্নির কাছে। পুন্নি কোনো এক মাদক বিক্রেতা গাজীর কাছে বসে আছে শাবিন আসবে বলে।
শাবিনকে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে সিগারেট জালালাম। ইউসুফকে ডেকে বললাম, যে ছেলেটা আমার কাছে এসেছিল সে চলে গেছে কিনা দেখে এসো।
সিগারেট শেষ হওয়ার আগে ইউসুফ এসে জানাল শাবিন চলে গেছে। রিল্যাক্স লাগছে। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কম্পিউটার ওপেন করে আগামীকালের জন্য সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলাম। হেডিং লিখেছি, মাদক ব্যবহার কমানোই যাচ্ছে না।
তারপর লিখলাম, বাংলাদেশের অবস্থান গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আর গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের মাঝামাঝি হওয়ায় বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বেশ সুবিধাজনক। এ ছাড়া বাংলাদেশে আছে প্রচুর নদী আর খাল। এসব নদী গিয়ে পড়েছে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্র উপকূল আর জলপথকে তাদের পণ্য পাচারের উপযুক্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করে।
(চলবে)
পর্ব ১২: অঘ্রানের অন্ধকারে