ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৩
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
-আমার হাঁড়িতে ছিল বলে দিতে পেরেছি। নইলেতো পারতাম না।
-যাক, আমাদের বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে পারলাম এটা আমাদের ভাগ্য। ওদেরকে খাওয়াতে পেরে আমাদের মনের কষ্ট কমেছে। আপনাকে সালাম জানাই।
-থাক, এত কথা বলবেন না। বাচ্চা দুটোকে খাওয়ানোর দায়তো আমারও ছিল। কিছুতেই ওদের কান্না শুনতে পারতাম না।
-আমরা সবাই এমন চিন্তায় শরণার্থী শিবিরে থাকব।
-হ্যাঁ, তাই থাকব। থাকতেই হবে। আমরা সবাই স্বাধীনতার জন্য এসেছি।
স্বাধীনতা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনি ওঠে চারদিকে স্বাধীনতা-স্বাধীনতা-বঙ্গবন্ধু-বঙ্গবন্ধু।
অঞ্জন নিজেও বলতে থাকে। ওর মন-প্রাণ ভরে যায় স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু শব্দে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াতো স্বাধীনতার সূচনা রচিত হতোনা। এক বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তিনি। সেই কর্মযজ্ঞে শামিল পুরো দেশবাসী। অনেকে আবার উল্টো কর্মে আছে। ওদের বিবেক নাই। ওদেরকে অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে স্বাধীনতাকামী মানুষের পায়ের নিচে।
আকরাম তখন বলে, চলো যে যার তাঁবুতে চলে যাই।
সবাই উঠে পড়ে। বাচ্চা দুটোর হাত ধরে ওদের বাবা। ওরা হাঁটতে শুরু করে।
অঞ্জন আকরামকে বলে, দেখেন ওদের শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনি।
-আহারে, এতটুকু ভাত দেয়া খুব বড় কাজ হয়েছে নাকি?
-হয়েছেতো বটেই। দেখছেন না ওদেরকে। দু’ভাই কেমন লাফালাফি করছে। ওরা প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। ওরা বলেনি যে আমরা একটুখানি ভাত খেয়েছি। আমাদের আরও ভাত দাও।
আকরাম হাসতে হাসতে বলে, ওরা বুদ্ধিমান ছেলে। বুঝে গেছে যে ভাত চাইলেই রাস্তায় ভাত পাওয়া যায় না।
অঞ্জন হা-হা করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, আপনার ব্যাখ্যা খুব সুন্দর। আপনি ওদেরকে বড় মানুষ বানিয়ে দিলেন।
-এই শরণার্থী জীবনের পরে স্বাধীনতা পেলে ওরা বড় মানুষ হবে।
ছেলেদুটোর বাবা-মা হাততালি দিয়ে বলে, আপনি ওদের জন্য দোয়া করবেন আকরাম ভাই।
-হ্যাঁ, দোয়াতো করবই। আল্লাহর রহমত থাকবে ওদের উপর। আমি যাই।
-আমরাও যাই।
যে যার মতো হাঁটতে শুরু করে। ধুলোমলিন রাস্তায় হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না অঞ্জন। এপাশে ওপাশে পা ফেলে হাঁটতে গিয়ে বিরক্ত হয়। দেখতে পায় অন্যরা একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে নিজের বিরক্তি কাটিয়ে নেয়। তারপর এলোমেলো পথে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে। ধুলোয় ধুসরিত এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা জীবনের সরলরেখা নয়। জীবনযাত্রার এলোপাতাড়ি নানা সংকটের চিহ্ন তুলে ধরেছে। প্রত্যেককেই এমন পথ বুঝে চলতে হবে। কখনো স্বপ্ন, কখনো কষ্ট, কখনো শান্তি, কখনো জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে হেঁটে যাওয়া বেঁচে থাকার সত্যের মাত্রা। অঞ্জন চারদিকে তাকায়। কত তাঁবু মানুষের দিনযাপনের জন্য। প্রত্যেকের সামনে স্বপ্ন একটাই। স্বাধীনতা। এভাবে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে সমষ্টির স্বপ্ন এক হয়। নিজের ভাবনায় আলোড়িত হয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ায় অঞ্জন। কেউ একজন ডাক্তার সাহেব বলতে বলতে ছুটে আসছে তার দিকে। কাছাকাছি এলে ও নিজেই বলে, কি হয়েছে আশরাফ?
-আমার ছেলেটার খালি পায়খানা হচ্ছে। কলেরা হলো নাকি? আপনি ওকে দেখতে চলেন।
-হ্যাঁ, চলেন।
দুজনে হাঁটতে শুরু করে। নানা তাঁবু থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ। অঞ্জন চারদিকে চারদিকে তাকিয়ে মুষড়ে পড়ে। তাঁবুতে তাঁবুকে কি অসুস্থতা শুরু হয়েছে। বুকের ভেতর টনটনিয়ে উঠে অঞ্জনের। আশরাফের তাঁবুর দিকে দ্রুতপায়ে হেঁটে যায়। তাঁবুতে পৌঁছে বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করে বলে, হ্যাঁ, ও কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। আমি হাসপাতালে গিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করব।
আশরাফ কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওষুধের জোগাড় করতে তো সময় লাগবে।
অঞ্জন ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, ধৈর্য ধরেন। আপনাকে কাঁদতে দেখলে ছেলেটার মন খারাপ হবে।
আশরাফ দুহাতে চোখ মুছে চুপ করে যায়। অঞ্জন বলে, যাই, অন্য তাঁবুতে কারা কাঁদছে দেখে আসি।
কয়েকটি তাঁবুতে গিয়ে টের পায় সবাই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। ওর শরীর কাঁপে থরথর করে। শরণার্থী শিবিরে কলেরার মহামারি শুরু হয়েছে এটা দেখে ও স্থির থাকতে পারে না। মেঘভরা আকাশ থেকে হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়। যশোর রোডের কাঁচা রাস্তা বৃষ্টির পানিতে কাদামাখা হয়ে যায়। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অঞ্জন কাদামাখা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে, শরণার্থী শিবিরে বাস করার এটা একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এর আগে কখনো এভাবে বৃষ্টিতে হাঁটেনি। বৃষ্টি পড়তে দেখলে ঘরে ঢুকেছে। তারপর বারান্দায় বসে বৃষ্টি পড়া দেখেছে। আজ ও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গুনগুন করে গায়, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’..।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে আসে অঞ্জন। ভেজার আনন্দ বুকের ভেতর জমে থাকে। কোনোরকম ভয় আসে না মনে। তাঁবুতে ফিরলে বাবা-মা বকবে এমন ধারণা পেয়ে বসে ওকে। ও আর এগোয়না। ফিরে আসে তাঁবুতে। বাবা ওর ভিজে থাকা অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলে, এত ভিজেছিস কেন? যদি জ্বর আসে মার খাবি।
মা গামছা এগিয়ে দিয়ে বলে, ভেতরে যা। গা মুছে তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে ফ্যাল।
অঞ্জন মায়ের হাত থেকে গামছা নিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়ে। শরীরজুড়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির ছোঁয়া তখনো বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ তুলছে। ও বুকের উপর গামছা চেপে ধরে গুনগুনিয়ে বলে বৃষ্টি আমার স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সোনার পানিতে ভিজে ভিজে মৃত্যুর দরজায় যাব। মৃত্যুকে বলব, মৃত্যু তুমি আমাকে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে রাখ। আমি স্বাধীনতা বুকে নিয়ে মরে যেতে চাই।
ওর মা মাথা বাড়িয়ে বলে, কি রে তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?
-বৃষ্টির সঙ্গে।
শব্দ করে হেসে উঠে ওর মা। হাসতে হাসতে বলে, ছেলেটাকে ডাক্তার বানিয়েছি। ওর নিজে নিজে কবি হয়েছে। বাড়িতে থাকতে জারুল গাছের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখন বৃষ্টি ওর কবিতা হয়েছে। ভালোইতো ফুল আর বৃষ্টি নিয়ে আমার ছেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে।
মায়ের কথা শুনে শব্দ করে হাসতে থাকে অঞ্জন। হাসতে হাসতে বলে, মাগো স্বাধীনতার স্বপ্ন এমনই। সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে স্বাধীনতা সবার মনে থাকবে। আমরা কখনোই স্বাধীনতার অমর্যাদা করবনা।
-তাঁবুতে যে চারদিকে কলেরা শুরু হয়েছে এটা কি সৌন্দর্য?
-মাগো এটাও সৌন্দর্যের আর এক দিক। এটা হবে মানবিক সৌন্দর্য। কলেরা রোগীদের আমরা কীভাবে দেখাশোনা করব সেটাই সৌন্দর্য। কাউকে আমরা অবহেলা করব না। এই সৌন্দর্য আমাদের বানাতে হবে।
-বুঝলাম। সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। তবে এটাও জানি মহামারি সাবইকে সাবধান থাকতে দেয়না। সবাধান থাকলেও গায়ে চেপে বসে। রক্ষা পাওয়া যায়না।
-থাক, এসব কথা। আমাদের এখন এত কথা বলার দরকার নাই।
-তুই যে বৃষ্টিতে ভিজলি এটা নিয়ে আমার চিন্তার ঝড় উঠেছে রে ছেলে। কেন তুই বৃষ্টিতে ভিজলি?
-মাগো এটাকে আমার একটা খেলা মনে হয়েছিল। কোনো ভয় ছিলনা মনে।
-সবই বুঝলাম। এখন জ্বর না আসলে আল্লাহর রহমত হবে।
অঞ্জন হাসতে হাসতে বলে, দেখা যাক কি হয়। মায়ের দোয়ায় সুস্থ থাকব।
মা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে, আল্লাহ তোকে সুস্থ রাখবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
অঞ্জন মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। দূর থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। দুজনে স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলেনা। শরণার্থী শিবিরে দিন কাটানোর কষ্ট বুকে নিয়ে বেদনায় ম্রিয়মান হয়ে থাকে।
চলবে…..