ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩২
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
অঞ্জন দ্রুত পায়ে হেঁটে এগোতে থাকে। চাল জোগাড়ের চিন্তা মাথার ভেতর গমগম শব্দ করে। অনুভবে দিশেহারা লাগে। নিজেকে শক্ত করার জন্য ভাবনার মোড় ঘোরায় চাল পাবে। পাবেই। শরণার্থী শিবিরের বড় জায়গা ধরে নিজের শক্তি বাড়ায় যুদ্ধ ও স্বাধীনতার পটভূমি শরণার্থী শিবির। বেঁচে থাকার সত্যকে ধারণ করে জীবনের জয়গান গায়। এসব ভাবতে ভাবতে যখন চাল দেয়ার ক্যাম্পে আসে দেখতে পায় কেউ নেই। ক্যাম্প বন্ধ। প্রবল মন খারপ নিয়ে ক্যাম্পের পাশের নিম গাছটা জড়িয়ে ধরে মাথা ঠোকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে যায়। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, গাছে মাথা ঠুকলেন কেন?
-চাল পেলামনা। মন খারাপ হয়ে গেল।
-না খেয়ে থাকতে হবে আপনাকে?
-আমাকে না। বিভিন্ন তাঁবুতে চাল নাই। ভাত রান্না হয়নি। শিশুরা কাঁদছে।
-আসেন আমার সঙ্গে। আমি তিন কেজি চাল কিনে দিচ্ছি দোকান থেকে।
-কিনে দেবেন?
-দিবইতো। না খেয়ে থাকবে কেন আমার দেশের শরণার্থীরা। যতটুকু পারি অতটুকু সাহায্য তো করবই।
অঞ্জন লোকটির দুহাত জড়িয়ে ধরে। বলে, মানুষকে ভালোবেসে আপনি একজন মহৎ মানুষ। আপনাকে শ্রদ্ধা করি।
লোকটি কথা বলেনা। অঞ্জনের হাত ধরে দোকানে যায়। তিন কেজি চালের তিনটি পোটলা নেয় দোকান থেকে। অঞ্জনকে দিয়ে বলে, যার যার লাগবে তাকে এক কেজি করে দিয়েন।
-হ্যাঁ, তা দেব। আপনাকে অনেক ভালোবাসা জানাই। দেশ স্বাধীন হলে আমি আপনাকে আমাদের দেশে বেড়াতে নিয়ে যাব।
-আপনার কষ্ট করতে হবেনা। আমি নিজেই যাব আপনার দেশে বেড়াতে। আমার জনম সার্থক হবে। আমাদের চেনাজানা পূর্ববঙ্গ একবার পূর্ব পাকিস্তান হলো। এখন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে। ভাবলে আমার মাথা তোলপাড় করে ওঠে। বাঙালি জাতির একটা স্বাধীন দেশ। আপনারা জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ভাবলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি কলেজে পড়াই। ছাত্র-ছাত্রীদের দরকার মতো ভাষা আন্দোলনের কথা বলি। এখন ওরা নিজেরাই দেখবে দেশটি স্বাধীন হয়েছে।
-আপনাদের সহযোগিতা না পেলে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না।
-আমিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি যেভাবে সহযোগিতা দিচ্ছেন সেটা একটি অতুলনীয় সিদ্ধান্ত। এটা বাঙালির একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জরুরি ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার সামনে একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আমি নিজেও খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাঁকে ছাড়াতো বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র হতো না।
অঞ্জন উদ্দীপিত হয়ে বলে, ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন। তিনি আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। আমি ভেবে রেখেছি যে দেশ স্বাধীন হলে আমি তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাব।
-পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেই হবে, না?
-তাও ঠিক। আপনাদের দেয়া চাল নিয়ে যাই। শিশুদের কান্নার শব্দ পাচ্ছি।
-হ্যাঁ, যান, যান।
অঞ্জন দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে। যিনি এত সুন্দর করে কথা বললেন তাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরায়। দেখতে পায় তিনি ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। অঞ্জন মৃদু হেসে হাত নেড়ে টা-টা বলে। লোকটিও হাত নেড়ে টা-টা বলে। গাঢ় হয় স্বপ্নের সেতু। ও আবার দ্রæতপায়ে হাঁটতে শুরু করে। কান্নার শব্দ ধরে সেই তাঁবুতে যায়। চাল দিয়ে চলে আসে। চাল জোগাড় করা গেছে ভেবে স্বস্তি বোধ করে। মানুষের চারপাশে এমনই মানুষই থাকে এটাই বেঁচে থাকার সত্য-সুন্দর। বর্বরতাকে ডিঙিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা সত্যের সুন্দরতা। অঞ্জন খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সীমান্তের দিকে তাকালে দেখতে পায় একদল শরণার্থী আসছে। এগিয়ে যায় সেদিকে। দেখতে পায় রঘু রাই দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে অমিয়ার চিন্তায় মাথা ভরে যায়। ভাবে, ও কি ঠিক আছে! কোনো পাক সেনার কবলে পড়েনি তো? বুকের ভেতর হাহাকার ধ্বণিত হয়। ও সীমান্তের একপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে এগিয়ে আসা নারী-পুরুষের দিকে। না, এই দলে অমিয়া বাবা-মায়ের সঙ্গে নাই। বোঝা যাচ্ছে, ওরা ঢাকা ছাড়বে না। অঞ্জন মন খারাপ করে চারদিকে তাকায়। সামনে বিরাট প্রান্তর নিঃশব্দে পড়ে আছে। তারপর ও নিজেকে ধমকায়। মাটি নিঃশব্দে পড়ে থাকবে কেন? এই মাটি বুক পেতে রেখেছে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য। একদিন এই মাটির উপর উড়বে বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা। তখন ও গুনগুন করে গাইতে থাকে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। শরণার্থীরা ঢুকে যাচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে। ও তাকিয়ে থাকে, তারপর কাছে এসে দাঁড়ায়। একজনকে জিজ্ঞেস করে, দেশের অবস্থা কি?
-পাকিস্তানি শয়তানরা যতই মারুক আমাদেরকে, ওরা টিকতে পারবেনা এই দেশে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ওদেরকে মেরে ভাগাবে।
-হ্যাঁ, তা ঠিক। যান, আপনারা এগিয়ে যান।
-তাতো যাবই। নইলে আসলাম কেন?
অঞ্জন কথা বাড়ায়না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। সারিবদ্ধ লোকেরা বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মাথায় পোটলা-পুটলি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওদের। অঞ্জন পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়, কতদূর পথ হেঁটে এসেছে। ক্লান্ততো হবেই। কোথায় ঠাঁই পাবে ওরা? এতকিছু ভাবনার মাঝে সীমান্ত অতিক্রম করে লোকেরা। কেউ কেউ বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গাছের নিচে বসে পড়ে। সীমান্ত রক্ষীরা জানাচ্ছে, আপনাদের যশোর রোডে জায়গা হবেনা। আপনারা কলকাতার দিকে এগিয়ে যান। অঞ্জন তাকিয়ে থাকে। দেখে যশোর রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শরণার্থীরা। ওরা কোথায় ঠিকানা পাবে ভাবতে ওর কষ্ট হয়। পরমুহুর্তে আশ^স্ত হয় এই ভেবে যে কোথাও না কোথাও ব্যবস্থা হবে। শরণার্থীদের জন্য ভারতের অনেক মায়া আছে। অঞ্জন হঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এসে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় দেখে দুটো নয়-দশ বছরের ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তার ওপর। ওরা ওঠে না। পড়েই থাকে। অঞ্জন দ্রুত গিয়ে ওদের ওঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ওঠাতে পারেনা। ওরা নিজেরাও ওঠার চেষ্টা করেনা। অঞ্জন বুঝতে পারে ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। ও ওদেরকে রাস্তার পাশে টেনে আনে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের বাবা-মা এসে হাজির হয়।
- কি হয়েছে আমাদের ছেলে দুটোর? ওরা পড়ে গেল কেন?
মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, পড়বেনা কেন? কাল দুপুরে আর রাতে ভাত খেতে পায়নি। ডাক্তার সাহেব আপনি দেখেন ওদের।
অঞ্জন বুঝতে পারে, ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। ওদেরকে তাঁবুতে নিয়ে যেতে হবে। হাত ঈশারায় ওদের বাবাকে ডেকে বলে, ওরা জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি একজনকে কোলে নিন, আমি একজনকে নিব। ওদেরকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে বিছানায় শোয়াতে হবে। ওরা জ্ঞান হারিয়েছে।
ওদের বাবা দুহাতে চোখ মুছে একজনকে কোলে তোলে। অঞ্জন আর একজনকে। হাঁটতে শুরু করে দুজনে। ওদের মা কাঁদতে কাঁদতে হাঁটে। কান্নার শব্দ শুনে চারদিক থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। আকরাম জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
অঞ্জন বলে, ছেলেদুটো জ্ঞান হারিয়েছে। পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। পেটে খিদা। ভাত খেতে পায়নি।
-আমার ঘরে অল্প ভাত আছে। আনব?
-আনেন, আনেন।
আকরাম ভাত আনার জন্য তাঁবুতে ঢোকে। অঞ্জন ওদের নিয়ে গাছতলায় বসে। ওরা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। ওদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। একজন বলে, ভাত খাব। ভাত খাব। অন্যজন বলে, মা কোথায় ভাত পাবে?
কাঁদতে শুরু করে চিৎকার করে দুজনেই। অঞ্জন চুপচাপ থাকে। ভাবে, কাঁদুক, কেঁদে শান্ত হোক। ওদের বাবা ওর কোলে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপরও ওর কান্না থামে না। তখন ওরা দেখতে পায় থালায় করে ভাত নিয়ে আসছে আকরাম। ওদের কান্না শুনে দ্রæত এগোয়। কাছে এসে ওদের মাকে থালা দিয়ে বলে, আপনি ওদেরকে খাইয়ে দেন। এই যে পানিও আনছি। আমি শুধু ভাতের মধ্যে ডাল দিয়েছি। কারণ আমাদের তরকারিতে খুব ঝাল থাকে। ওরা খেতে পারবেনা।
-আচ্ছা দেন।
ওদের মা থালাভরা ভাত ডাল দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে ওদের মুখে দেয়। ছেলেরা দ্রæত চাবিয়ে গিলে ফেলে। আবার হাঁ করে। দুজনকে ভাত খাওয়াতে পেরে পরিতৃপ্ত হয়ে যায় সবাই। আকরামও ওদের সঙ্গে বসে থাকে। অঞ্জনের মনে হয় শরণার্থী শিবিরে এ একটা অন্যরকম দৃশ্য। ও যে কয় মাস থাকল এতদিনে এখানে এমন দৃশ্য দেখেনি। এই দেখাটা আজকে ওর সামনে স্বাধীনতার স্বপ্নের ফুল হয়ে ফোটে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্কইতো বেঁচে থাকার সত্য। ও আকরামের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই ভাই। আপনি বাচ্চাদুটোর পেট ভরে দিয়েছেন।
চলবে...