১৯৭১
"জানিস দাদুভাই! ভিষণ গোলাগুলি হচ্ছিল তখন। গেরিলা আক্রমণে আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি শত্রুদের দিকে। ওরাও থেমে ছিলোনা। একেরপর এক খই ফোটার মতো গুলি করেই যাচ্ছে। এমন সময় আমাদের আবদুল ভাইয়ের বুকে গুলি লাগলো। অবস্থা বেগতিক। কমান্ডার শামসুল ভাইকে বললাম আবদুল ভাই সহ সবাইকে নিয়ে ফিরে যেতে। আমার সাথে দুটো মাইন। পাশাপাশি অস্ত্র আছে। এদিকটা আমি সামলে নিতে পারবো। যদিও মৃত্যু নিশ্চিত। পাকবাহিনী এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমরা তখন অসহায়।"
বলেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন আহতাব রহমান। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজের সাত বছর বয়সী নাতি আহনাফকে মুক্তিযু্দ্ধের সময়কার তার এক ভয়ংকর লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি। সেদিন যদি সেই ছেলেটা দেবদূত হয়ে না আসতো তাহলে হয়তো আজ তিনি জীবিত থাকতে পারতেন না। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নাতির নামও সেই ছেলেটার নামে রেখেছেন।
"ও দাদুভাই বলোনা। পরে কি হয়েছিলো?"
নাতির দিকে তাকিয়ে আবারও অতীতে ডুব দিলেন আহতাব।
১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণা দিলেন,
"রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা।"
বাঙালির রক্ত টগবগ করছে তখন। বহু বছরের পরাধীনতার জাল ছিঁড়ে বাঙালি মুক্তি চায়। স্বাধীনতা চায়। বঙ্গবন্ধুর ডাক যেন ছিল তারই প্রতিচ্ছবি। আহতাব একজন সরকারি কর্মকর্তা। উপস্থিত হয়েছেন রেসকোর্স ময়দানে। তারও রক্ত টগবগ করছে। মনে মনে একটাই চাওয়া। স্বাধীনতা। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ২৫ শে মার্চের অতর্কিত হামলা। ৩০ বছরের আহতাব সদ্য বিবাহিত বউ নিয়ে ভিষণ ঝামেলায় পড়লেন। বাইরে হানাদার বাহিনীর হামলা। কি করবেন! কোথায় যাবেন! হতভম্ব হয়ে আছেন আহতাব। অতঃপর বহুকষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি পৌঁছালেন। হাতের উপর হাত দিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করলোনা তার। চারিদিকে হাহাকার, বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। কয়েকজন মিলে চলে গেলেন ভারত ট্রেনিং করার জন্য। একে একে গেরিলা প্রশিক্ষণ, বন্দুক চালনা, মাইন ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠলেন সকলে। একের পর এক ধ্বংস করতে লাগলেন শত্রুদের একেকটি বাঙ্কার। এমনই একদিন। শত্রুপক্ষের সাথে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। চারিদিকে খই ফোটার মতো গুলির আওয়াজ। ওরা ছয়জন এগিয়ে যাচ্ছে শত্রুদের দিকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখনই। দুজন গুলি খেয়ে সাথে সাথে মারা গেলেন। তখনও চারজনে আক্রমণ চালাচ্ছেন। সবচেয়ে দক্ষ আবদুল রহমানের বুকে গুলি লাগতেই ঘাবড়ে গেলেন সকলে। তাছাড়া গুলিও কেবল কয়েকটা রয়েছে। এখনই ফিরে না গেলে নির্ঘাত প্রাণ যাবে। পাকবাহিনী বুঝতে পারলে মহা ঝামেলা হবে। কাউকে উপস্থিত থেকে তাদের ধোঁকার ভিতর রাখতে হবে। গুলি চালালে পাকবাহিনী দ্রুত আসবেনা এদিকটায়। আহতাব কমান্ডার শামসুলের উদ্দেশ্যে বললেন,
"ভাই, আপনি ওদের নিয়ে চলে যান। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। আবদুল ভাইকে নিয়ে ফিরে যান।"
"আহতাব এটা কি করে সম্ভব! তোমাকে ফেলে কি করে যাবো আমরা। তুমি দক্ষ একজন যোদ্ধা। এমনতেই আমরা দুজনকে হারিয়েছি।"
ভাঙা কন্ঠে বললেন শামসুল। পাকবাহিনী এগিয়ে আসছে। আহতাব চিৎকার করে বললো,
"ভাই, আমার চিন্তা না করে আপনারা ফিরে যান৷ আল্লাহর দোহাই।"
অবস্থা বেগতিক দেখে শামসুল বাধ্য হয়ে বাকি দুজনকে নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় মাটিতে পড়ে থাকা দুটো লাশের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। চোখ ফেটে এলো জল। দ্রুত চোখ মুছে প্রস্থান করলেন তিনি। আহতাব একা একাই গুলি চালাচ্ছে। একসময় ফুরিয়ে এলো গুলি। পাকবাহিনী ধরে ফেললো আহতাবকে। স্কুল মাঠের বাঙ্কারে বেঁধে নিয়ে চললো তাকে। কর্নেল ওসমানের সামনে হাজির করা হয় আহতাবকে। কর্নেল ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রাজাকার মোল্লাকে উর্দুতে বললেন,
"ওকে বলো আস্তানার ঠিকানা বলতে। তাহলে ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে।"
মোল্লা পান খাওয়া লাল দাঁত দিয়ে ভ্যাবলা হেসে বললেন,
"জ্বে, স্যার।"
"আহতাব মিয়া জলদি কইরা ঠিকানা কইয়া দাও স্যাররে।"
আহতাব বললেন,
"কিসের ঠিকানা?"
"তোমাগো আস্তানার।"
"মেরে ফেললেও বলবোনা।"
মোল্লা বিরক্তির সাথে তাকিয়ে আধাভাঙা উর্দুতে কর্নেল ওসমানকে বললেন,
"স্যার, আহতাব নাকি কহেগা নেহি।"
পাশে থাকা পানির গ্লাসটা আহতাবের মাথায় ছুড়ে মারলেন ওসমান। হুংকার ছাড়লেন। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে অথচ আহতাব নির্বিকার। প্রচুর মারধর করা হলো তাকে। রাত দুইটায় নদীর পাড় নিয়ে গুলি করা হবে । বাঙ্কারের এককোনায় বেঁধে রাখা হলো তাকে। ক্লান্ত, ব্যথায় ক্লিষ্ট আহতাব নিবুনিবু চোখে নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন। এমন সময় একটা আলো জ্বলে উঠলো চোখের সামনে। কে যেন এগিয়ে আসছে।
"এই যে। আপনি ঠিক আছেন? আপনি কি আহতাব রহমান?"
"হুম"
বলে আবার চোখ বুজলেন আহতাব। শরীরে প্রচুর ব্যথা। আস্তে আস্তে ব্যথাগুলো দূর হতে লাগলো। ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। শরীরে শক্তি ফিরে পাচ্ছেন আহতাব। আচমকা তিনি চোখ মেলে পাশে চিন্তিত এক যুবককে দেখতে পেলেন।
"কে? কে তুমি?"
"সেসব কথা পরে হবে আপনি আমার সাথে বাইরে চলুন।"
বলেই আহতাব সাহেবের হাতের বাঁধন খুলে দিলো ছেলেটি। আহতাব মুক্ত হলেন। আফসোস হচ্ছে মাইন দুটো নিয়ে নিয়েছে পাকবাহিনী। সাথে অস্ত্রও নেই। ফর্সা যুবকটা কাঁধের ব্যাগ হাতে নিয়ে কি যেন একটা বের করলো।
"এটা কি?"
"আপনাদের ভাষায় মাইন। তবে আরো শক্তিশালী।"
বলেই বাঙ্কারের মাটিতে পুঁতে দিলো মাইনটি। আহতাব অবাক হয়ে যুকটিকে দেখে যাচ্ছেন। এমন পোশাক পরিহিত মানুষ তিনি কখনো দেখেননি।
"আপনি এই অস্ত্রটি ধরুন।"
বন্দুকের মতো একটা অস্ত্র ছেলেটি ধরিয়ে দিলো আহতাব সাহেবের হাতে। আহতাব বিস্ময় নিয়ে বললেন,
"তুমি পাকবাহিনীর লোক?"
ছেলেটা একটু হাসলো। মাথা নেড়ে না জানালো।
"আপনি পরে আমাকে প্রশ্ন করবেন। আগে বাইরে চলুন। দশমিনিটের মাঝে মাইন ফেটে যাবে।"
বের হওয়ার কালে একজন সিপাহি দেখে ফেললো তাদের। ঘাবড়ে গেলেন আহতাব। যুবক ঘাবড়ালো না। বন্ধুক দিয়ে গুলি ছুড়লো। সোজা মাথায় লেগেছে সিপাহির। অথচ কোনো শব্দ হলোনা। সিপাহি আর্তনাদ করে পরে যেতেই দৌড়ে বাইরে বের হওয়ার কালে আবার বিপত্তি ঘটলো। আহতাবকে দেখে ফেললেন কর্নেল। হুংকার ছেড়ে দৌড়ে বের হতে নিতেই যুবক আবার গুলি করলো তাকে। আশেপাশে কোনো হানাদার নেই। তারা বেশিরভাগই অন্য বাঙ্কারে অবস্থান করছে। হাতে তখন পাঁচ মিনিট। মিনিমাম একশ মিটার দূরে না সরতে পারলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। বহুকষ্টে দৌড়ে বাইরে পালাতে সফল হলো তারা। আর পিছনে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলো। উড়ে গেলো হানাদারদের আস্তানা। আহতাব হাঁটুতে ধরে হাঁপাচ্ছিলেন। পাশের ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিতে পাশ ফিরে দেখলেন একটা উজ্জ্বল আলোর ভিতর ছেলেটি হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন,
"এই ছেলে কে তুমি?"
"আহনাফ। আমি আহনাফ।"
বলেই ছেলেটা হারিয়ে গেলো। জ্ঞান হারালেন আহতাব।
দাদার মুখে প্রায়ই এই গল্পটা শুনতো আহনাফ। আজ সে ত্রিশ বছরের যুবক। দাদাজান বেঁচে নেই। একশত বছর জীবিত ছিলেন আহনাফের দাদাজান। আহনাফ নিজের ব্যাকপ্যাকটা রেডি করে নিলো প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে। তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হয়েছে অবশেষে। টাইম ট্রাভেল আবিষ্কার করতে সে সফল। আহনাফ এখন ছুটে চলেছে ১৯৭১ সালে।
ডিএসএস/