সাহায্যের আকুতি জানিয়ে পাকিস্তানি বন্যার্তদের চিরকুট
'আমাদের খাবার দরকার, আমাদের ওষুধ দরকার এবং দয়া করে সেতুটি পুননির্মাণ করুন, আমাদের এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।' এই ছিল পাকিস্তানের বানভাসি মানুষদের একটি চিরকুটের লেখা। বিবিসির প্রতিবেদকরা বন্যা আক্রান্ত এলাকায় যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাদের দিকে এই চিরকুট ছুঁড়ে মারছিলেন।
পাকিস্তানে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে মানুর উপত্যকায় আকস্মিক বন্যার কারণে নদীর দুইধারে আটকে পড়েছে শত শত মানুষ। শুক্রবার হঠাৎ ধেয়ে আসা পানির স্রোতে সেখানে দশটি সেতু ভেঙে যায়। ধসে পড়ে বহু ভবন।
কাঘানের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত মানুর উপত্যকা পাকিস্তানের একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। উপত্যকাটি প্রবল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, যাতে নারী ও শিশুসহ অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
উপত্যকাটিকে মূল শহরের সঙ্গে সংযোগকারী একমাত্র কংক্রিটের সেতুটি আকস্মিক বন্যায় ভেসে গেছে। এরপর থেকে নদীর ওপারের সব গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেখানকার বাসিন্দারা সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছেন।
গাড়িতে এক ঘণ্টার বিপজ্জনক পথ চলার পর বিবিসির দলটি উপত্যকায় পৌঁছায়। সেখানে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে রাস্তাঘাট অনেক স্থানেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মানুরে দুটি সেতু সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে এবং একটি অস্থায়ী কাঠের সেতু তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হলে এক নারী জানান, যতটুকু সহায় সম্বল রয়েছে সেগুলো নিয়ে বসে আছেন তিনি। বলছিলেন তিনি তার বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না।
'আমার বাড়ি ও আমার ছেলে-মেয়েরা নদীর ওপারে। সরকার এসে সেতুটি মেরামত করে দেবে ভেবে দুই দিন ধরে এখানেই অপেক্ষা করছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের বলছে যে আমাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করা উচিত। কিন্তু সেটা আট থেকে দশ ঘণ্টার হাঁটা পথ। আমি একজন বৃদ্ধ মহিলা। আমি এতটা পথ হাঁটব কী করে?'
তিনি সেখানে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। আবার বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর অস্থায়ী কাঠের সেতুটির নীচে প্রবাহিত পানি আরও ফুলে উঠতে শুরু করলে তিনি সেখান থেকে চলে যান।
নদীর ওপারে মাটির ঘরের বাইরে নারী, পুরুষ ও শিশুরা বসে ছিল। তারা বিবিসির প্রতিবেদক দলকে দেখে সরকারি কর্মকর্তা ভাবে তাদের দিকে হাত নাড়ছিল। তখনই তাদের কেউ কেউ নদীর ওপার থেকে কাগজে চিরকুট লিখে, প্লাস্টিকের ব্যাগে পাথর ভরে সেগুলো তার মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
হাতে লেখা এই চিরকুটে তারা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যে পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করছে সে সম্পর্কে জানায়। আটকে পড়া গ্রামবাসীদের জন্য দরকারি রসদ ও ওষুধের অনুরোধও করে।
একটি চিরকুটে লেখা ছিল, 'অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা পায়ে হেঁটে গ্রাম ছেড়ে যেতে পারছে না। দয়া করে সেতুটি বানিয়ে দিন। এটিই শহরের সাথে যোগাযোগের প্রধান উপায়।'
ষাট বছর বয়সী আব্দুল রাশিদ নিজের দুর্দশার কথা বর্ণনা করে বলছিলেন, 'আমাদের রসদ দরকার, রাস্তা দরকার।'
বন্যায় তিনি তার ঘোড়ার গাড়িটি হারিয়েছেন। পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য সেটিই ছিল অর্থ উপার্জনের একমাত্র উপায়।
'এরকম আরও বহু মানুষ আছে যারা তাদের সহায় সম্পত্তি ও আয়ের উৎস হারিয়েছে', বলছিলেন তিনি।
'ওদের সাহায্য দরকার, খাবার দরকার। এখানে ছোট একটা বাজার ছিল যা পুরো ভেসে গেছে। সেখানে দোকানে সব খাবার আর দরকারি রসদ ছিল।'
আমার বাড়ি নদীর ওপারে। এখন আমাকে আট ঘণ্টা হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। এত বুড়ো বয়সে আমি কীভাবে তা পারবো?' প্রশ্ন করলেন তিনি।
এখানে অনেক দোকান ও হোটেল ধ্বংস হয়ে গেছে। সোহেল ও তার ভাই তাদের মোবাইল ফোন মেরামতের দোকানটি বন্যায় হারিয়েছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, তাকে তিনটি পরিবারের খাবারের জোগান দিতে হয়। তার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
"এখন কি যে করব বুঝতে পারছি না। কেউ আমাদের সাহায্য করতে এখানে আসেনি। যা আমাদের খুবই দরকার। এখানকার প্রতিটি দোকানদার চিন্তার মধ্যে আছে। তারা সবাই গরীব মানুষ।', বলছিলেন সোহেল।
'এইসব কর্তৃপক্ষ ও রাজনীতিবিদরা এখানে শুধু আসে ফটোসেশন আর ফুর্তি করার জন্য। তারা আসে, ছবি তোলে ও চলে যায়। কেউ আমাদের সাহায্য করছে না।'
তবে সেখানকার ডেপুটি কমিশনার বিবিসিকে বলেছেন, ওই এলাকায় দ্রুততার সঙ্গে ব্যাপক উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান চালানো হয়েছে এবং সব হোটেল খালি করা হয়েছে। কী পরিমাণে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে সম্পর্কে ইতিমধ্যেই হিসাব করা হয়েছে।
এই বন্যার জন্য সরকার জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করলেও সেখানকার বাসিন্দারা নদীর তীরে হোটেল নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করছে।
'এই হোটেল ও বাজারগুলো পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক জলপথগুলো অবরুদ্ধ করেছে এবং সেই কারণেই বন্যায় আমরা অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি যা সহজেই এড়ানো যেত', কাঘানের বাজার এলাকার আর এক বাসিন্দা বলছিলেন।
কাঘানের কুনহার নদীর তীরে এবং সংলগ্ন উপত্যকায় অনেক হোটেল তৈরি করা হয়েছে। বন্যায় বেশ কিছু হোটেল, একটি পুলিশ স্টেশন এবং একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে।
পাকিস্তানজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে প্রবল বর্ষণ ও বন্যা। পাকিস্তানের স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় এক হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে সাত লাখের মতো বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।
খাবার, পানীয় জল এবং আশ্রয়ের অপেক্ষায় রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। মানুর উপত্যকার মতো এলাকায় বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়গুলোর কাছে পৌঁছাতে ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলগুলিকে।
বন্যায় সিন্ধু ও বালুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে খাইবার পাখতুনখোয়ার পার্বত্য অঞ্চলগুলোও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কারণে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ সংস্থাগুলোকে পৌঁছাতে সহায়তা করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোর একমাত্র উপায় এখন হেলিকপ্টার।
দুর্যোগ মোকাবেলায় পাকিস্তানের সরকার বন্ধুপ্রতিম দেশ, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে সহায়তার আবেদন করছে।
টিটি/