বিজয়বনের মুক্ত পাখি
চারিদিকে গুমোট পরিবেশ। সকাল থেকে আকাশে মেঘ জমে রয়েছে। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। ফলে গরম কমারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলের ভেতর বসে দরদর করে ঘামছে মুক্তিসেনারা। দশ জনের ছোট্ট একটা দল। গাছের কয়েকটা ডাল কেটে একটা তাবু কোনোমতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি একবার এসে পড়লে অতটুকু জায়গায় সবাই শান্তিমতো বসতে পারবে কি-না সন্দেহ আছে। তবুও সবাই বৃষ্টির দেখা চায়। গরম ক্রমশ অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছে।
আকাশের কালো মেঘের মতো দেশের আকাশেও দুর্যোগের ঘনঘটা। হঠাৎ করেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলার মানুষের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। পুরো দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একেবারে ছারখার করে দিচ্ছে ওরা। ওদের বিরোধিতা করে এমন কোনো মানুষকেই জীবিত রাখবে না।
হাসানের পরিবারের কাউকেও জীবিত রাখা হয়নি। সে কোনোরকমে সেদিন চোখের জল সম্বল করে পালিয়ে এসেছিল। তারপর মুক্তিবাহিনীর সাথে ভিড়ে গেছে।
দশজনের এই দলটাতে হাসান বাদে বাকি সবাই ভারত থেকে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। হাসানকেও তারা সীমানা পেরিয়ে ওপারে যেতে বলেছিল। কিন্তু সে যেতে রাজি হয়নি; বলেছে, 'আমাকে আপনারা কেউ অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দিলেই হবে।'
'ভারতে গেলে ঠিকমতো শিখতে পারবি। ওরা ভালো ট্রেনিং করায়।'
বলেছিল ক'দিনের ভেতর খুব কাছের বন্ধু হয়ে যাওয়া হৃদয়। কিন্তু হাসান বলে, 'আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমি যুদ্ধ করতে চাই। পাকিস্তানি শুয়োর মারতে মারতে আমি শহিদ হতে চাই। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরে আসবো এত সময় কোথায়!'
হাসানের মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন দলের কমান্ডার। পরদিনই তিনি হাসানকে ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। কমান্ডার যে শুধু তাকে অস্ত্র চালানোই শিখিয়ে দিলেন তাই নয়; কীভাবে অ্যামবুশ করতে হবে, গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে কীভাবে- সবই শেখনো হয় হাসানকে। সে খুব দ্রুতই যুদ্ধের সমস্ত কলাকৌশল শিখে নেয় এবং দলের সেরা গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত হয়।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করেছে।
হাসানের পোষা ময়না পাখিটা বৃষ্টি পড়তে দেখে ডাকাডাকি শুরু করেছে। সবাই তাবুর ভেতর প্রবেশ করলে হাসান খাঁচাটাকে নিয়ে তাবুর এক কোনায় ঝুলিয়ে দেয়। তারপর ময়নার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, 'বল তো, এই বৃষ্টি আমাদের জন্য সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে?'
ময়না কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসান দলের বাকি সদস্যদের দিকে চেয়ে দেখে, তারা সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ও সবার কাছে চলে আসতে গেলে ময়না চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, 'বিজয়...বিজয়...বিজয়...'
অবাক হয়ে যায় সবাই; হাসানও। কারণ, কথাটা মোটেও সে তাকে শেখায়নি।
হাসান ফিরে এসে মাটিতে বসে পড়ে। সবাই কোনোমতে গোল হয়ে বসার সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে কথা বলে ওঠেন কমান্ডার।
'এই বৃষ্টিটার জন্য আমরা সারাদিন অপেক্ষায় রয়েছি। সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। হাসান ময়নাকে যে প্রশ্ন করেছে তার উত্তর আমি দিচ্ছি—এই বৃষ্টি আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে।'
কমান্ডারের চিন্তাধারা আগে থেকে অনুমান করা মুশকিল। তার কাজের ধরনই আলাদা। সামনে বসে থাকা বোকাসোকা জয়নাল প্রশ্ন করে, 'এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?'
কমান্ডার রহস্যময় হাসি হেসে বলেন, 'নিশ্চয়ই কারণ আছে। আজ রাতে আমরা নদী পেরিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করবো।'
'একে তো বৃষ্টির রাত—তার ওপর ঘুটঘুটে অন্ধকার। নদী পার হতে সুবিধাই হবে বটে।'
যোগ করে হাসান। তার বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতার ওপর অগাধ ভরসা কমান্ডারের।
কমান্ডার বলেন, 'আমি এই অভিযানের নেতৃত্ব হাসানের ওপর দিলাম। তুমি পাঁচজনকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নদী পার হয়ে যাও। অন্ধকার যখন একেবারে গাঢ় হয়ে আসবে তখনই আক্রমণে যাবে।'
দলের সদস্যরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। কমান্ডার বুঝতে পারেন সব।
'আমি বাকি তিনজনকে নিয়ে ক্যাম্প পাহারায় থাকছি। আল-বদর বাহিনী রাতে হামলা করতে পারে।'
বু্ক টানটান করে উঠে দাঁড়ায় হাসান। তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে সবাই। কমান্ডারের বুকের সঙ্গে বুক মেলায় সে। তারপর পাঁচ সঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকারে।
কমান্ডার যেভাবে বলেছিলেন, আক্রমণ পর্যায়টা তেমন সহজ হয়নি। পাকিস্তানিরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতই ছিল। হাসানের বাহিনী আক্রমণ শুরু করতেই ওপার থেকে তীব্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তবে এই জল-কাঁদার ভেতর ওদের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যায় থাকা সত্ত্বেও পাক বাহিনী বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। সাতটা লাশ পেছনে ফেলে আস্তানা ছেড়ে পালিয়েছে ওরা। এদিকে হাসানের বুকেও বিদ্ধ হয়েছে গুলি। সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে রক্তের ফোঁটা মিশে গিয়ে আশেপাশে লাল রঙের স্রোত তৈরি করেছে।
সহযোদ্ধারা ধরাধরি করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে হাসানকে। এখনো বেঁচে আছে সে। কমান্ডার এগিয়ে এসে কান পাতেন বুকে। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে। হাসান চোখ খুলে তাকায়। সহযোদ্ধাদের সবার চোখেমুখে কান্নার ছাপ। তারা জাতির একজন সাহসী সন্তানকে হারাতে যাচ্ছে।
হাসান তাকায় তার পোষা ময়নার দিকে। সে বড় ছুটাছুটি করছে। হয়ত মুক্তির আকুতি জানাচ্ছে হাসানের কাছে। হাসান ইশারায় বুঝিয়ে দেয় ময়নাকে ছেড়ে দিতে। ওর এখন মুক্তি প্রয়োজন। কমান্ডার এগিয়ে যান খাঁচার দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতে খুলে দেন খাঁচার মুখ। ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে কালো মিশমিশে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ময়না পাখিটা। সহযোদ্ধারা ময়নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাসানের দিকে চেয়ে দেখে, তার বুকের ভেতর থেকেও প্রাণপাখিটা বেরিয়ে অন্ধকার রাতের বুকে মিলিয়ে গেছে।
ডিএসএস/