অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা
অনেকক্ষন যাবৎ হাঁটছি। কোনো রিকশা পাচ্ছি না। হাঁটতে ভালই লাগে আমার কাছে, বিশেষ করে এ জায়গাটাতে। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর গাছপালা, অনেকটা ঝোপঝাড়ের ন্যায়। বেশ কিছু তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। শান্তশিষ্ট, নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশ। সন্ধ্যা নামতেই যেন ভূতুরে অন্ধকার জেঁকে বসে। রাইনাদি গ্রাম পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিমুলতলী বাজারে এসে উপস্থিত। আজ এ এলাকাতে কী রিকশা ধর্মঘট চলছে নাকি ? মনে মনে ভাবছি। সারাটা রাস্তা জুড়ে খালি রিকশা তো নাই-ই, যাত্রীসহ কোনো রিকশা ও চোখে পড়লনা ।
বেড়ানোর সূত্রে মাঝে মাঝে এ এলাকায় আসা হয়। খুব বেশি একটা পরিচিত এলাকা না। বাজারেও কোনো রিকশা নেই। হাঁটতে আর ভালো লাগছে না তাই রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। বেলা বড়জোড় এগারোটা। বয়স্ক এক রিকশা ওয়ালা যাত্রীবিহীন রিকশা নিয়ে এ দিকেই আসছে।
“চাচা, যাবেন ?” জিজ্ঞেস করলাম। “যামু, তবে এক কাপ চা খাইয়া লই”। উত্তর দিলেন রিকশা চালক। “আচ্ছা, চলেন তাহলে আমিও খাই এক কাপ”।
এক চালা টিনের মাচাটাকে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে রাখা দোকানের সামনে দুইটা কাঠের বেঞ্চি। দোকানে কোনো খরিদ্দার নাই। এই সময়ে বাজারের চায়ের দোকানে দু’চার জন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাজারটা নাকি নতুন পত্তন পাওয়া আর এ শিমুলতলী বাজারটা ও নিতান্তই ছোটখাট। আড়াআড়ি দু’ বেঞ্চে দু’জন বসলাম।
“চাচা, চায়ের আগে বিস্কুট বা কেক কিছু একটা খান”।“ না-না, আপনে খাইলে কিছু খান। আমি শুধু এক কাপ চা-ই খামু”। “আচ্ছা, ঠিক আছে। দুধ চা নাকি রং চা ?”
“চাচার অভিব্যক্তিতে বুঝা গেল, তিনি অপরিচিত ব্যক্তির আপ্যায়নে এক কাপ চা বিনা পয়সায় খেতে সম্মত না। অবশেষে আমার পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন। দু’ জনেই রং চা নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম- “চাচার নাম ?” “রমিজ আলী”। “বাড়ী ?” “টোডার বাগ”। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর। “চাচার বয়স কত হবে আনুমানিক ?” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করলাম। “এই- কত- আর সত্তুর অইব হয়তো।” উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন রমিজ চাচা। “কই যাইবেন ?” বিল দিয়ে বললাম- “আপনার ইচ্ছা। ইলমদী বা তিলচন্দী। যেখানে আপনি রাজি হন”। “রিশকা যহন চালাই, যেনে কন হেনে-ই যামু”। রিকশার পেডেলে চাপ লাগালেন।
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতাম, চাচা।” কী পরশন করবেন এই বুড়া বয়সেও ক্যান রিশকা চালাই- এইডাই তো ?” কথার মধ্যে কেমন যেন ক্ষোভ, ঘৃনা, অভিমান, লজ্জা জড়িয়ে আছে। আমি কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। আজকালের অটো রিকশার জমানায় ও পায়ে চালানো রিকশা, তদুপরি বয়স্ক চালক। ফলে রিকশার গতি ও মন্থর। আমার হাতে অফুরন্ত সময়, আমি ও মনে মনে চাইছি আরো ধীরে চলুক রিকশা টা। লোকটার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে আমার। “উত্তরটা দিলেন না যে চাচা ?”
পিছন ফিরে এক ঝলক তাকালেন। মনে হলো চোখ দুটো যেন ঝাপসা। অস্ফুট স্বরে বললেন, “কপালের দোষ, বাজান।” “আপনার ছেলে সন্তান নাই ?” “হ” আছে- দুই পোলা এক মাইয়া। মাইয়া বিয়া দিয়া দিছি। পোলারা বিয়া শাদী কইরা নায় নাতি লইয়া যের যের সংসারে ব্যস্ত - আমগোরে দেহোনের সময় কই ? আমরা বুড়াবুড়ি ভালই আছি- মাশাল্লা। দোয়া কইরেন। পোলারা আর কী করব, দেশই কী কিছু করলনা”। তিলচন্দির রাস্তা পার হয়ে ইলমদীর রাস্তায় এসে পড়েছি। মনে সন্দেহ বাজল, উনি কী মুক্তিযোদ্ধা ?
“চাচা, কী মুক্তিযোদ্ধা ?” “এই কতা জিগাইয়া আর শরম দিয়েন না।” আমি অবাক স্বরে বললাম, এটা কেমন কথা বললেন চাচা, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া তো গৌরবের কথা, সম্মানের বিষয়- এটা লজ্জার ব্যাপার হবে কেন ? “ততক্ষনে ইলমদী চলে এসেছি।” নামেন, আমার ভাড়া দেন।” কন্ঠস্বরটা বেশ কর্কষ মনে হলো। “চাচা কী আমার উপর রাগ করেছেন ?” “না-না, আফনে আমার কী হন যে আপনার উপর আমি রাগ করমু। আমার সময় নষ্ট কইরেন না। ভাড়া দিয়া নাইমা যান।” “আমি সামনের শান্তির বাজার যামু, চলেন।” “ভাড়া কত দিবেন ?” জিজ্ঞেস করলেন। “আপনি যা চান ?” নরম হয়ে আসে চাচা স্বর। আস্তে আস্তে রিকশার প্যাডেল চাপতে থাকেন। “মুক্তিযোদ্ধাদের তো সরকার অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। আপনি পাচ্ছেন না ?” “মুক্তিযোদ্ধাদের লিষ্টে আমার নাম নাই।”
“কেন- কেন ?” “কেওরে ধন্না দইরা মুক্তিযোদ্ধার লিষ্টে নাম উঠানোর লাইগ্যা তো যুদ্ধ করি নাই। যুদ্ধ করছি দেশের লাইগ্যা, দেশের মানুষের লাইগ্যা।”
“চাচা, সামনের বটতলায় রিকশাটা থামাইয়া চলেন আরো এক কাপ চা খাইয়া নিই।” বুঝার বাকি রইল না- কঠিন এক মানুষ। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, খাঁটি দেশ প্রেমিক। চা খাওয়া উপলক্ষ্যে অনেকক্ষন কথা হলো। অনেক অজানা কথা, আবেগের কথা, ভাললাগার কথা, ভালোবাসার কথা, যুদ্ধকালীন নির্মম অনেক স্মৃতির কথা, নির্দয় পাকিস্থানীদের কথা, নির্ঘুম অনেক রাতের কথা, অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে দিনানিপাতের কথা, স্বজনদের ছেড়ে দূরে থাকার কথা, এমন অনেক কথা যে কথা কখনো কাউকেই বলা হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী অবহেলার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম না উঠার কথা। এমন-ই অসংখ্য আলাপ। “জীবন বাজী রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন। বিনিময়ে কিছুই পেলেন না। কষ্ট হয় না আপনার ?” জিজ্ঞেস করলাম, “না---হ’, নিশ্বাস ফেলে সহজ উত্তর। আবার চলা শুরু। এ বয়সে ও এত কষ্ট করছেন অথচ দেখার কেউ নেই। কাউকে বলছেন ও না কিছু। ভিতরে আমার কান্না চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
বিড়বিড় করে বলছেন-“পোলাগো কাছেই কিছু আশা করি না আর দেশের কাছে কী আশা করমু।” দাসিরদিয়া ব্রিজ পার হওয়ার পরে বেশ নিরিবিলি একটা জায়গা। রাস্তার দু’পাশে বেশ গাছপালা। অনেক দূর পর্যন্ত কোনো গ্রাম নেই। রাস্তার ডানে বামে দু দিকেই সবুজ ফসলি মাঠ। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, বিশাল প্রান্তর। স্বাধীন দেশের মুক্ত প্রানের ছোঁয়ায় যেন গ্রাম বাংলার প্রকৃত রূপ। এ অপরূপ, মুক্ত স্বাধীন দেশটাকে আমার দেখার অসাধারণ সৌভাগ্য তো হয়েছে এ সাধারণ রিকশা চালক রমিজ আলীর জন্য। স্যালুট, তোমাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধা। বললাম- “চাচা, রিকশাটা থামান।” “কেন- বাজান ?” চাচা রিকশা থামালেন, “চাচা, কষ্ট করে রিকশা থেকে একটু নেমে আসবেন ?” আমি রিকশা থেকে নেমে বললাম। রিকশা থেকে নামলেন রিকশা চালক রমিজ আলী। “আমি আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চাই।” পায়ে হাত লাগানোর আগেই জোড়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন মুক্তিযোদ্ধা রমিজ আলী আর হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। চলতি পথে কোনো রিকশা বা অন্য কোন গাড়ীর যাত্রীর অথবা কোনো মেঠো পথচারীর চোখে এ দৃশ্য পড়ল কিনা জানি না তবে তার কান্নার দৃশ্য আমার চোখে এখনো সতেজ।
খুচরা দু’তিন শ’ টাকা বাদ দিলে পকেটে মাত্র এক হাজার টাকার একটা নোট। ভাড়া দিতে সাহসে কুলাচ্ছেনা। এক হাজার টাকার নোটটা হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বললাম- “চাচা, মাফ করবেন। আমার যদি এখন পাঁচ হাজার, দশ হাজার বা পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়ার সামর্থ্য থাকতো আমি তা-ই দিতাম। আপনার সন্তান মনে করে টাকাটা রাখবেন।” কিছুতেই রাজি হলেন না, চাচা। অগত্যা নির্ধারিত ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরলাম। চাচা বললেন-“হাঁইটা যাইতে কষ্ট অইব না, আপনের।” তার চাইতে কতগুন কষ্ট করেছেন আপনি আমাদের জন্য। মনে মনে বললাম- এ রিকশায় চড়ে আমি আর মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করতে পারিনা। অন্তত পক্ষে বাকী রাস্তা টুকু পাঁয়ে হেঁটে তার প্রায়শ্চিত্ত করি। আমি রিকশা থেকে নেমে গেলে ও রিকশা হয়তো খালি থাকবে না। কোন না কোন যাত্রী এ রিকশায় চড়বেই। কিন্তু সবাই তো আর আমার মত এ প্রচার বিমুখ অভিমানী মুক্তিযোদ্ধার মনের গভীরের কথা জানবে না। কিছু দুর এগিয়ে পিছন ফিরে তাকাই। আবার চোখে চোখ পড়ে যায়। দেখি সে চোখে যেন বর্ষার বৃষ্টি ভর করে আছে।
ডিএসএস/