বিশ্বকবির স্মৃতিচিহ্ন নওগাঁর পতিসর কাচারি বাড়ি
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার মনিয়ারী ইউনিয়নে এক ছোট্ট গ্রামের নাম পতিসর। সড়কের দুপাশে তালগাছের সারি, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এমন গ্রামীণ পটচিত্র পেরোলেই চোখে পড়বে একতলা শ্বেতশুভ্র কাচারি বাড়ি। ১৯৩৭ সালে ২৬ জুলাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো এসেছিলেন তার পতিসরের কাচারি বাড়িতে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি একটি অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। পতিসরের ভূমি, বর্তমানে যা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিচিহ্ন পতিসর কাচারি বাড়ি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৮৩০ সালে বিশ্বকবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ কালীগ্রাম পরগনা কিনে পারিবারিক জমিদারির অংশে অন্তর্ভুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রথম পদচারণ করেন ১৮৯১ সালের ১৬ জানুয়ারি। এরপর এটাকে খাজনা আদায় ও জমিদারি দেখাশোনার জন্য ব্যবহার করা হয়।
রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য সাত কক্ষবিশিষ্ট এই বাড়িতে প্রথমেই দৃষ্টি কাড়বে সিংহদুয়ার নামক প্রবেশপথের দিকে, যেখানে বীরবিক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি সিংহ।
দৃষ্টিনন্দন এই কাচারি বাড়িকে ঘিরে এখানে বেশ কিছু ভবনও রয়েছে, যেগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনো নজর কাড়ে পর্যটকদের। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপদে অবস্থান ও বিশ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতিনীড় নামক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক বিশ্রামাগার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন ও রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা।
কাচারি বাড়ি-সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্বাংশে নির্মাণ করা হয়েছে দেবেন্দ্র মঞ্চ, কবির স্বপ্নের নাগর নদের ওপর রবীন্দ্র সেতু, পাশে নাগর ঘাট, মণিতলায় তালগাছ ছড়ার সেই তালগাছ স্মৃতিস্মারক এবং দর্শনার্থীদের জন্য পিকনিক স্পট, রন্ধনশালা ও পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা। রয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতি বিনোদন পার্ক। তবে বাড়িটির সম্মুখ পশ্চিমাংশরবীন্দ্র সরোবর নামক পুকুরটি বর্তমানে মজা-ডোবায় পরিণত হয়েছে।
সামনে বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, পাশ দিয়ে বয়ে চলা নাগর নদ, গ্রাম-বাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের হাতছানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপেক্ষা করতে পারেননি। রচনা করেছেন। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ বিশ্বকবির এ বিখ্যাত কবিতাটি তিনি লিখেন নওগাঁর আত্রাইয়ের পতিসরের কাচারি বাড়িতে বসে। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদীকে কেন্দ্র করেই এটি লেখেন বলে জানা যায়।
১৮৯১ সালের পর কবি বহুবার এসেছেন পতিসর কাচারি বাড়িতে নাগর নদী পথে বজড়ায় চড়ে। ১৮৯১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এ পতিসরে বসে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিঠিপত্র, কাব্য নাটিকা লেখেন। এ পতিসরে বসে কবি রচনা করেছেন কাব্য নাটিকা, বিদায় অভিশাপ, গোরা ও ঘরে-বাইরে উপন্যাসে অনেকাংশ। ছোট গল্পের মধ্যে প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা, ইংরাজ ও ভারতবাসী প্রবন্ধ। গানের মধ্যে যেমন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা/তুমি আমার নিভৃত সাধনা,’ বধূ মিছে রাগ করো না, তুমি নবরূপে এসো প্রাণেসহ অনেক গান। দুই বিঘা জমি, তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে কবিতাসহ বিভিন্ন কবিতা। কবির স্মৃতিবিজড়িত মনিতলার পূজামণ্ডপের সেই তালগাছটি আজ আর নেই। তবে রবীন্দ্র গবেষকদের ধারণা, পতিসর কুঠিবাড়ির সামনে যে দুই বিঘার মাঠটি আছে সেটিই কবির রচিত কবিতা দুই বিঘা জমির সেই মাঠটি হবে। কবির ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ সালে এ এলাকার প্রজাদের জন্য সর্বপ্রথম আধুনিক সময়ের কলের লাঙ্গল এনেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার ১৯৫২ সালে এক অর্ডিন্যান্স বলে কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি কেড়ে নিলে ঠাকুর পরিবারের এ জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সস্ত্রীক পতিসর যাতায়াত বন্ধ করে দেন।
প্রায় এক একর জমির ওপর অবস্থিত এই কাচারি বাড়িতে সংরক্ষিত রয়েছে বিশ্বকবির ব্যবহার্য আসবাবপত্র—যার মধ্যে রয়েছে আরামকেদারা, বাথটাব, ফোল্ডিং চেয়ার, কৃষি ব্যাংকে ব্যবহৃত সিন্দুক, কলের লাঙলের ফলা, পদ্মা বোটের নোঙর, বোটের দরজার পাল্লা, ওয়্যারড্রোব, সিন্দুক, ভাতের পাত্র, বোটে ব্যবহৃত গ্লোব, ব্যবহৃত পদ্মা বোটের অনুকৃতি, কবির স্বহস্তে লেখা বহু চিঠিপত্র, দেয়াল আয়না, নাগর বোটে ব্যবহৃত দেয়ালঘড়ি, কেটলি, কাঠের আলমিরা, কাছারি বাড়িতে ব্যবহৃত সেই সময়ের খাট, টেবিল, চেয়ারসহ কবির অসংখ্য ছবি। বাড়িটির প্রাঙ্গণে রয়েছে রবীন্দ্র ভাস্কর্য এবং রবীন্দ্র সরোবরের সম্মুখে তাঁরই আবক্ষমূর্তি।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। তাই ভ্রমণপিপাসুরা নিঃসন্দেহে ট্রেনে আসতে পারেন এখানে। ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন নীলসাগর, লালমনি এক্সপ্রেস অথবা দ্রুতযানে চড়ে প্রথমে আত্রাই আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা। অথবা বাসযোগে নওগাঁ বা নাটোরে এসে সেখান থেকে আত্রাই হয়ে পতিসর। নওগাঁ থেকে পতিসরের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার। বাসে ভাড়া লাগবে ঢাকা-নাটোর ৩৮০ টাকা এবং ঢাকা-নওগাঁ ৪০০ টাকা। কেউ চাইলে বর্ষা মৌসুমে নাটোর হতে নৌকাযোগেও সরাসরি আসতে পারেন। নওগাঁ থেকে আত্রাই আসার একমাত্র যান হলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা। চাইলে মিনিবাস রিজার্ভ করেও আসা যাবে। আত্রাই থেকে পতিসরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। আত্রাই থেকে পতিসর আসতে হলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা চার্জার ভ্যানে আসা যাবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা করে।
কাচারি বাড়ির দক্ষিণে শানবাঁধানো রবীন্দ্র সরোবরের পশ্চিম পাড়ে রয়েছে দুটো ডাকবাংলো। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই ডাকবাংলো দুটিতে চারটি করে মোট কক্ষ রয়েছে আটটি। সাধারণ তিনটি কক্ষে জনপ্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা এবং দুজন হলে ২০০ টাকা। ভিআইপি পাঁচটি কক্ষের ভাড়া ৮০০ টাকা করে। প্রতিকক্ষে থাকা যাবে দুজন করে। ডাকবাংলো দুটোয় থাকতে হলে জেলা পরিষদের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং খাবারের বিষয়টিও ওখান থেকে নিশ্চিত করে আসতে হবে। এখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে রয়েছে নদী ও বিলের দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
সরকারি ছুটির দিন, রবিবার পূর্ণদিবস, সোমবার অর্ধদিবস (দুপুর দেড়টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা) বন্ধ থাকে। মঙ্গল থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন খোলা থাকে।
কাচারি বাড়িতে সংরক্ষিত কোনো বস্তুর ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ কিংবা সংরক্ষিত বস্তুসমূহ স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। একসঙ্গে ২০ জনের বেশি একই কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। পরিবেশ রক্ষার্থে ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, এই সংরক্ষিত পুরাকীর্তিটিতে কবির জন্মোৎসব (২৫ বৈশাখ) উপলক্ষে সরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র উৎসব ও তিনদিনব্যাপী (২৫, ২৬ ও ২৭) মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এখানে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। এ ছাড়া চাইলে বর্ষাকালে এসে নাগর নদের বুকে নৌকায় কিছুটা সময় প্রফুল্লচিত্তে কাটানো যেতে পারে।