বেঁচে আছে ২২টি ঢোপকল
পুটিয়ার বিখ্যাত জমিদার মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী রাজশাহীর মানুষকে কলেরার হাত থেকে ঢোপকল তৈরি করে দিয়ে বাঁচিয়েছেন। এখন যে ২২টি বেঁচে আছে, সেগুলোকে নিয়ে লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন মাহাবুল ইসলাম
১৯৩০ এর দশকে রাজশাহীতে পানিবাহিত রোগ কলেরার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। নোংরা, জীবাণুতে ভর্তি পানি খেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছিলেন। তখন পুটিয়ার জমিদার মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবীর টাকায় সুপেয় পানির কলের ব্যবস্থা করা হলো। যুগান্তকারী উদ্যোগে বানানো হলো ‘ঢোপকল’। সুপেয় পানির সরবরাহকারী কল হিসেবে ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল তারা। তবে এখন ঢোপকলের উপযোগীতা ফুরিয়েছে। রাজশাহী ওয়াসার পানির লাইন আছে আলাদা। তারপরও বিভিন্ন সড়কে প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘ঢোপকল’। একসময় ১শর বেশি ছিল। রাজশাহী শহরে এখন মোটে মাত্র ২২টি সচল আছে।
এক, একটি ১২ ফিট উঁচু, ৪ ফিট চওড়া। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই কলগুলো বিশেষভাবে বানানো। মূল উপকরণ সিমেন্ট ও ইটের খোয়া। প্রতিটি কলের গায়ে ওপর থেকে নিচের দিক পর্যন্ত বিশেষ একটি ঢেউ খেলানো ডিজাইন রয়েছে। নকশাটি করা হয়েছে টিনে। চারিদিকে টিনের রাউন্ড বানিয়ে তার ভেতরে সিমেন্ট ও ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হয়েছে। ঢালাইটি আড়াই থেকে তিন ইঞ্চির, আজও দারুণ শক্ত। অসাধারণ ডিজাইন, পুরোটাই সিমেন্টের দারুণ কারুকাজ আর পানির ফিল্টারিং ব্যবস্থা রাজশাহীর ঢোপকলের বিশেষত্ব।
এই সবগুলো ঢোপকলে সুপেয় পানি দেবার জন্য মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী নিজের নামে একটি বিশেষ পানিশোধন কেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার কেন্দ্র থেকেই লোহা ও পানির ক্ষার দূর করে ঢোপকলে পানি দেওয়া হতো। কলগুলোর প্রতিটির আলাদা ফিল্টারিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরোপুরি স্বচ্ছ ও সুপেয় পানি খেতেন নগরের মানুষ। পাথরের কুঁচি আছে ভেতরে কোনোভাবে ঢুকে পড়া ময়লাগুলো থেকে পানিকে বাঁচাতে। বালি এবং পাথরের স্তরও আছে প্রতিটি কলে। তাছাড়াও সিমেন্টের কল বলে পানি কোনোভাবেই গরম হয় না। শীতকালে তীব্র শীতের প্রভাব পড়ে না পানিতে।
১৯৩৭ থেকে ১৯৬৫ টানা ২৮ বছর রাজশাহী শহরের সুপেয় পানি ব্যবস্থা ছিল ঢোপকলগুলোর মাধ্যমে। এরপর নগররায়ন হলো। ওয়াসা এলো। তারা নিজেদের ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। তারপরও যে কটি বেঁচে আছে, সেগুলোর হাতে গোনা কটিকে তারা রিজার্ভ পানির ট্যাংকি হিসেবে সচল রেখেছেন। পানিও দেন কোনো কোনোটিতে সাধারণ মানুষকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র জেলা শাখার সভাপতি ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেছেন, ‘আমাদের রাজশাহী নগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহের কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ঢোপকলগুলো। মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবীর দান ও প্রশাসনিক এই উদ্যোগ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সে সময় নগরবাসীকে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে ঢোপকল স্থাপন প্রকল্প যে জীবনদায়ী ভূমিকা রেখেছে, এই প্রকল্পকে রাজশাহী ওয়াসা রক্ষা করতে পারেনি। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহের প্রশ্নেও ওয়াসা পিছিয়ে আছে। আবার আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ঢোপকলগুলো যত্ন ও কাজে লাগানোর অভাবে পিছিয়ে গিয়েছে। নগর উন্নয়ন কাজে কিছু ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ. এইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের আন্তরিকতা ও ও সুশীল সামাজের দাবিতে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বাকিগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই ঢোপকলগুলো ভবিষ্যতের কাছে স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।’ 
রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. পারভেজ মাসুদ বলেছেন, ‘সময়ের সাথে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। ঢোপকলগুলোর কার্যকারিতাও এখন বিলুপ্তিতে। তবে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রাজশাহী নগরের দর্শনীয় স্থান, গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও জাদুঘরে ঢোপকলগুলো স্থানান্তর করা হচ্ছে।’
ওএস।
