আমের নাম ‘নাকফজলি’

নানা জাতের আম পাওয়া যায় বাংলাদেশে। এত সব জাতের আম কোথা থেকে এলো, কিংবা কোন আম কোন জেলায় বিখ্যাত? যারা আম খেতে ভালোবাসেন? জেনে নিন ‘নাকফজলি’ আমটি বাংলাদেশে কীভাবে এলো?
‘আম রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত নওগাঁয় ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, ক্ষীরশাপাত, বারি-৪, গুটি জাতের আম দেশ বিদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। এ ছাড়া জেলায় বিখ্যাত ‘নাকফজলি’ আম বেশ সুনাম অর্জন করেছে।
‘নাকফজলি’ আম নিয়ে বর্ণিত আছে, নওগাঁর বদলগাছী ভান্ডারপুরের জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ীর হাত ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা থেকে প্রথম বাংলাদেশে আসে। পরবর্তীতে ‘নাকফজলি’ নামে পরিচিতি পায় এই অঞ্চলে।
কৃষি বিভাগ ও চাষিদের কাছ থেকে জানা যায়, এই আমের আসল নাম হচ্ছে ‘নাকফজলি’। গঙ্গাতীরবর্তী কাশী বা বেনারস ভারতের প্রধান আম উৎপাদন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিনোদ কুমার লাহিড়ীর মাধ্যমে বদলগাছী উপজেলায় প্রথম বিস্তার লাভ করেন ‘নাকফজলি’। অনেকে মনে করেন, ‘নাকফজলি’ বাংলাদেশের একটি আমের জাত। এই জাতের আম দেখতে কিছুটা নাকের মতো। নাক ফজলি আমের জীবনকাল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় প্রথম এই আমের চাষ শুরু হয়।
স্থানীয়দের তথ্যসূত্রে জানা যায়, তৎকালীন সার্বভৌম শাসক ছিলেন ইংরেজরা। ১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ থেকে গোটাল ব্রিটিশ উপনিবেশ। তিনটি খণ্ডে দুটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল অখণ্ড ভারত। ভাগ হলো বাংলা। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ভান্ডারপুরে বিনোদ কুমার লাহিড়ী পরিবারের জমিদারি অঞ্চল ছিল। প্রতিবছর জমিদার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তীর্থে যেতেন ভারতে। ফেরার পথে সঙ্গে নানা ধরনের ফলজ গাছের চারা নিয়ে আসতেন। যেমন- কাশি ফজলি, বোম্বে ফজলি, দেবীভোগ, মালদা ফজলি ও নাকফজলি। যে এলাকা থেকে ফলের চারা নিয়ে আসতেন, সেই এলাকার নামের প্রথম অক্ষর দিয়েই নামকরণ করতেন তিনি। এরপর থেকেই ‘নাকফজলি’ আম কলমের চারার মাধ্যমে আশপাশের গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে যেতে থাকে। এভাবেই আমটি পরিচিতি পায় ভান্ডারপুর গ্রামের বাইরে। নওগাঁর দুবলহাটি ও বলিহার রাজবাড়ির বাগানেও এ আমের গাছ ছিল বলে জানা যায়। বদলগাছীর শ্রীরামপুর, দেউকুড়ী, কোলা, ভান্ডারপুর, দ্বীপগঞ্জ ও দুধকুরি গ্রামে এ আমের অসংখ্য বাগান গড়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ীর উত্তরসূরি নাতি শ্রী নিরঞ্জন লাহিড়ী বলেন, 'আমার দাদা জমিদার খুকুমণি লাহিড়ী তার ভালো নাম ছিল কার্তিক লাহিড়ী। যুগেশ লাহিড়ী, মুহেশ লাহিড়ী এরা তিন ভাই ভান্ডারপুরের জমিদারি দেখাশোনা করতেন। এরা সকলে ভারতে বিয়ে করেছিলেন। দাদু কলকাতা থেকে নাকফজলি, ল্যাংড়া, মালদহ, গোপালভোগ, সাদা পড়া, এবং বারো মাসী আমের চারা শখ করে এনে নিজ জমিদারি এলাকায় রোপন করতেন এবং পার্শ্ববর্তী দুবলহাটি ও বলিহার রাজাদের উপহার দিতেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার দাদারা ভারতের রায়গঞ্জ, কলকাতা, কালীগঞ্জে বিয়ে করেন। এমনকি আমার ৭ পিসি (ফুপু) সবার বিয়ে হয়েছিল ভারতে। এ কারণে প্রতিবছরই তীর্থে গয়াকাশি যেতেন। ফেরার পথে সঙ্গে নানা রকমের ফলের চারা নিয়ে আসতেন। এভাবেই ভান্ডারপুরের মাটিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আমটি।'
এ বিষয়ে কথা হয় ভান্ডারপুর (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহীনূর ইসলাম স্বপনের সাথে। তিনি বলেন, 'আমি যেটুকু জানি এই ‘নাকফজলি’ আম বিনোদ কুমার লাহিড়ী নামে এক ব্যক্তি ভারত থেকে একটি চারা এনে ভান্ডারপুরের মাটিতে রোপণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এই চারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই সারাদেশে এই আমের জন্য এ অঞ্চলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এই আমটি আগে আমাদের ভান্ডারপুর হাট থেকে বিক্রি হতো। বর্তমানে হাট থেকে বিক্রি হয়না। বাগান থেকে আম বিক্রি হয়ে যায় অনলাইনে। এই অঞ্চলের মতো এত সুস্বাদু নাকফজলি আম দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না।
স্থানীয় আবদুল মান্নান বলেন, আমরা ১৯৬৪ সালে এই অঞ্চলে বসবাসের জন্য আসি। এ অঞ্চলে আসার পর প্রশ্ন করেছিলাম, এই আমের নাম কী? কোথা থেকে আনলেন? উত্তরে তারা বলেছিলেন, প্রায়ই তাদের কলকাতায় যাওয়া আসা ছিল। সেখানে আমটি খেয়ে ভালো লেগেছিল। আসার পথে একটি চারা এনে রোপন করেন। এভাবেই সারা দেশে পরিচিত লাভ করেছে এই অঞ্চলের ‘নাকফজলি’ আমটি। দেশের অনেক অঞ্চলে হয় কিন্তু এই অঞ্চলের মতো আম এত সুস্বাদু হয় না।'
এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদক রকিবুল হক বলেন, 'ব্যক্তিগত আমার খুব প্রিয় আম ‘নাকফজলি’। এই আমটি শুধুমাত্র বাদলগাছিতেই সবচেয়ে বেশি আম বাগান রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে নিরাপদ আম উৎপাদন করে আসছি। এ বছর আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে। বাগানের পাশাপাশি রয়েছে নিরাপদ সবজি ক্ষেত। নিরাপদ প্রাকৃতিক কৃষি চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিয়ে ফল ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করছি।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সামসুল ওয়াদুদ জানান, ‘নাকফজলি’ এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। গাছ পাকা ‘নাকফজলি’ ঘ্রাণ জন্ম দেয় অসাধারণ এক অনুভূতির। এ আমের আরেকটি বিশেষত্ব একটু শক্ত হওয়ার কারণে পচে না সহজে। গাছ থেকে নামানো ‘নাকফজলি’ দীর্ঘদিন ধরে ঘরে রেখে খাওয়া যায়।
তিনি আরও জানান, ‘নাকফজলি’ আম লম্বায় প্রায় চার ইঞ্চি আর চওড়ায় দেড় ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর নিম্নাংশ বাঁকানো। নাক বড় এবং স্পষ্ট বেরিয়ে আসা। আমটির গড় ওজন ৩০০ গ্রাম। আকারে অনেকটা বড় এবং নাক স্পষ্ট, এ কারণে এর নাম হয়েছে ‘নাকফজলি’ শুধু নওগাঁ জেলায় পাওয়া যায়।
এসজি/
