নব্বই বছরেও ভার কাঁধে চানাচুর বিক্রি করেন নজরুল
৪০ বছর ধরে কাঁধে সওয়ার হয়েছে চানাচুর ও শুঁটকির ভার। বয়স পেরিয়েছে ৯০, শীর্ণ কাঁধ এখন আর সেই ভার বইতে চায় না। কিন্তু কাঁধ থেকে সেই ভার নামাতেও পারছেন না। কারণ ভারে করে বিক্রি করা চানাচুর ও শুঁটকির বদৌলতেই দুমুঠো অন্ন জোটে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মজিরনের।
নজরুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তঘেষা খলিশাকোঠাল গ্রামে। এক ছেলে ও এক মেয়ে ব্যস্ত নিজের সংসার নিয়েই। বাবা-মায়ের খোঁজ নেন না কেউ। তাই তো নব্বই বছর বয়সেও সংসারের জোয়াল কাঁধে হাঁটছেন ক্লান্ত নজরুল ইসলাম।
উপজেলা নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গজেরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত ভবনের বারান্দার ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে বসে ঝাল চানাচুর বিক্রি করছেন নজরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে ঝাল চানাচুর কিনে খাচ্ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিশু শিক্ষার্থীসহ ওই এলাকার মানুষ। স্কুল ছুটির পর কুরুষাফেরুষা এলাকায় চলে যান চানাচুর ও শুঁটকি বিক্রি করতে।
চানাচুরওয়ালা নজরুল ইসলাম বলেন, আমি খুব অভাবি। আবাদি জমি-জমা নেই। মাত্র ১০ শতক জমিতে স্ত্রীসহ থাকি। এ বয়সেও চানাচুর বিক্রি করে কোনো রকমেই দিন পার করেছি। চানাচুর ও শুঁটকি বিক্রি করেই ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে মানুষ করেছি। প্রায় ৩০ বছর আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি অনেক কষ্ট করে। এরপর ছেলেটাকেও বিয়ে দিয়েছি। দুর্ভাগ্য আমার একমাত্র ছেলেটাকে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা-মাকে ফেলে আলাদা সংসার করছে। খুব কষ্ট মনে।
শরীরটা চায় বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রাম করলেও তো ক্ষিদেটা যায় না। পেটের তাড়নায় কাঁধে চানাচুর ও শুঁটকির নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ফেরি করে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ৯০ বছর বয়সের কোনো বাবা জীবন-জীবিকার তাগিদে ভার ঘাড়ে নিয়ে চানাচুর ও শুঁটকি বিক্রি করছেন কি না জানি না। আমি করছি। প্রতিদিন পথে ঘাটে ঘুরে ঝাল চানাচুর ও শুঁটকি বিক্রি করে আয় হয় মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ৪০ বছর ধরে এ কাজ করছি। ছেলে-মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে জমাতে পারিনি এক টাকাও। দুই বুড়োবুড়ির ভরণ-পোষণ ও ওষুধপত্র কিনতেই অবস্থা খারাপ। অনেক সময় ধার-দেনা করেও চলতে হয়। এ বয়সে ভার ঘাড়ে করে চানাচুর বিক্রি করার শক্তি নেই। পুরো শরীরে ব্যথা। দু-মুঠো খাবারের জন্য এসব করতে হচ্ছে। বৃদ্ধ ভাতা ও চানাচুর বিক্রি করে অনেক কষ্টে বেঁচে আছি।
থাকার ঘরটিও অবস্থা ভীষণ নাজুক। চাটাইয়ের বেড়া ও টিনের তৈরি ঘরটিও জরাজীর্ণ। গ্রামে বৈদ্যুতিক আলোর সুবিধা থাকলেও তিনি তা পান না। বৈদ্যুতিক লাইন পেতে যে টাকা দিতে হবে, তা তার সামর্থ্যের বাইরে। তাই কূপির আলোতেই কাটাতে রাত। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ঘর প্রত্যাশা করেন নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী মজিরন বেগম বলেন, আমার স্বামী চানাচুর বিক্রি করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা রোজগার করে। আর বয়স্ক ভাতা তা দিয়া কোনো রকমেই দুই বুড়া-বুড়ি খাই। একনা বেটা বিয়ে দিয়েছি। বৌসহ ঢাকায় থাকে। দুই বুড়াবুড়ির খোঁজ খবরও নেয় না। কোনো রকমে ভাঙাচোরা একটা বাড়িতে থাকি। সরকার থেকে যদি একটা পাকা ঘরের ব্যবস্থা করে দিত খুবই ভালো হতো বাহে!
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল আলিম জানান, নজরুল ইসলাম নব্বই বছর বয়সেও এসে ভার ঘাড়ে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি এ পেশায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ বছর ধরে আছেন। তিনি অসুস্থ থাকার পরেও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করে সংসার চালান। তার সৎ কর্মের জন্য তাকে সালাম জানাই। নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী দুজনেই বয়স্ক ভাতা পান। তবে তার ঘরের অবস্থা ভালো না। তাই আমি চেষ্টা করব তারা যেন একটা সরকারি ঘর পান।
এ প্রসঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস জানান, দুই স্বামী-স্ত্রী যেহেতু বয়স্ক ভাতা পান এটা খুবই ভালো। তবে সামনের অর্থ বছরে সরকারি ঘরের বরাদ্দ এলে তাদের ঘর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এসএন