নেত্রকোনায় বিলুপ্তির পথে পুষ্টিকর বেতফল
নেত্রকোনা জেলার চিরচেনা চিত্র হলো বাড়ির পেছনের অংশে বাঁশ ঝাড়, গাব গাছসহ অযত্নে বেড়ে ওঠা বেতগাছ। কিন্তু এই বেতগাছ এখন বিলুপ্তির পথে। হারিয়ে যাচ্ছে বেতগাছ, সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বেতফলও।
ফুল আসে আশ্বিন-কার্তিক মাসে আর ফল পাকে চৈত্র, বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে। এটি অপ্রচলিত ফল হলেও অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। এ ফলকে বেতফল বা বেতুন বলে। এটি যেমন পুষ্টিকর তেমন সুস্বাদু ও ওষুধিগুণ সমৃদ্ধ। মূলত মাটির অবস্থার ওপর নির্ভর করে এ ফল খুব মিষ্টি হয়। আবার স্থান ভেদে একটু টকও হয়। বেতফল মরিচ দিয়ে চাটনি করে খেতে খুব মজাদার। পাকা বেতফল এমনিতেই খেতে দারুণ সুস্বাদু।
গ্রামের কৃষকের অতি প্রয়োজনীয় গাছ হিসেবে পরিচিত বেতগাছ। বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প যেমন চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারি, ঢুষি, হাতপাখা, চালোন, টোকা, গোলা, ডোল, ডুলা, আউড়ি, চাঁচ, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এটি গৃহনির্মাণ কাজেও ব্যবহৃত হয়।
বিশেষ করে রেস্তোরাঁ বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। এ ছাড়া লম্বা বেত ফালা করে নানা কিছু বাঁধার কাজেও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কালের আবর্তে মানুষ তার প্রয়োজনে ঝোপঝাড়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে কৃষকরা বেত বিক্রি করার জন্য আসতেন। একটি ২০-২২ হাত লম্বা বেত আগে বিক্রি হতো ২০ থেকে ২৫ টাকায়। কিন্তু আজ সেই বেত ১৫০ টাকা দিলেও পাওয়া যাচ্ছে না। বেতের চাহিদা থাকলেও নেই তা দিয়ে তৈরি আসবাবপত্র।
মোহনগঞ্জ উপজেলার খুরশিমূল গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জন সরকার জানান, গত কয়েক বছর আগেও তিনি তাদের বাড়ির আঙ্গিনাসহ গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বেত গাছের বাগান দেখেছেন। কিন্তু এসবের চাহিদা কমে যাওয়ায় আজ এ বাগানগুলো আর দেখা যায় না। শহরায়ন ও নগরায়নের কারণে আজ মানুষ এসব বাগান উজাড় করে ফেলেছেন।
জহির মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, ছোট বেলায় বেত ফল দিয়ে খেলাধুলার পাশাপাশি এগুলো শখ করে খেয়েছেনও অনেক। কিন্তু বর্তমানে এগুলো আর চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ গাছ ও ফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নেত্রকোনা শহরের বেত ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি এ ব্যবসার সঙ্গে প্রায় ২০ বছর জড়িত ছিলাম। কয়েক বছর আগেও ওড়া বা ধামার চারদিক মজবুত করে গিঁট দেওয়ার জন্য বেত ব্যবহার করা হতো। আজ বেত অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় এর স্থান দখল করেছে প্লাস্টিকের দড়ি বা রশি।
মনিরুল ইসলামের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় কেটে সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করছেন। এতে যেমন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি প্রয়োজনীয় প্রজাতির লতানো গাছ, তেমনি হারাচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। তিনি এখন বেতের পাশাপাশি প্লাস্টিকের আসবাবপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এসএম মোবারক আলী বলেন, রেস্তোরাঁ বা অফিসের কক্ষে শৌখিন পার্টিশন হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়া লম্বা বেত ফালা করে নানা কিছু বাঁধার কাজেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কালের আবর্তে মানুষ তার প্রয়োজনে ঝোপঝাড়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে। বেতফল এখনকার ছেলেমেয়েরা চিনে না। এটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল।
এসজি/