সিলেটে বিলুপ্তির পথে দেশীয় প্রজাতির মাছ, হাইব্রিডের দখলে বাজার
যে পুকুরগুলোতে একসময় পাওয়া যেতো দেশীয় প্রজাতির মাছ, এখন তা বিলুপ্তির পথে। সেইসব পুকুরে এখন চাষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ফলে মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির শত শত মাছের স্থান দখল করে নিচ্ছে পুকুরে উৎপাদিত হাইব্রিড শ্রেণীর মাছগুলো। দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্তির পর হাওর তীরবর্তী বাজারগুলোতে আধিপত্য এখন পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, কৈ-এর মতো খামারের মাছের। বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে খামারে চাষ করা পাঙ্গাশ মাছ।
দেশি মাছ বিলুপ্তির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার এবং অবাধ মৎস্য নিধন। এসবের ফলেই একের পর এক বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ফলে এক যুগ আগেও সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে প্রায় ১০৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে এবং আরও কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে বলে জানায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস।
সিলেট জেলা মৎস্য অফিস জানায়, বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। এর মধ্যে মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙ্গাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা। আর সঙ্কটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড় এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালিবাউশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক আকারে কীটনাশক ব্যবহার, হাওরের ইজারা প্রথা, সেচ দিয়ে মাছ শিকারসহ বিভিন্ন কারণে হাওরের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। কীটনাশকের কারণে মাছ ডিম কম দিচ্ছে। সব ডিম থেকে বাচ্চাও ফুটছে না। অনেক সময় হাওরে মাছ মরে ভেসে উঠতেও দেখা যায়।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল জানান, চলতি মৌসুমেও সুনামগঞ্জে ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩২দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। যত্রতত্র এই বাঁধ নির্মাণকেই হাওরের মাছ কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
তিনি আরও বলেন, গত অর্থ বছরে ৯০ হাজার ১৩০ দশমিক ২৫ টন মাছ পাওয়া গেছে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জলাশয় থেকে। এর মধ্যে নদী থেকে ৪ হাজার ৫৪৪ দশমিক ৪৫ টন, বিল থেকে প্রাকৃতিকভাবে ২৮ হাজার ৬২৪ দশমিক ৩৯ টন, বিলে পোনা অবমুক্তের মাধ্যমে ৬০ দশমিক ৯০ টন, হাওর থেকে ৩৪ হাজার ১৩৪ দশমিক শূন্য ৭ টন এবং প্লাবনভূমি থেকে ২ হাজার ৭১৫ দশমিক ২৫ টন।
সংশ্লিষ্টরা হাওরের মাছ কমে আসার কারণ হিসেবে মনে করছেন, মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলে বাধাগ্রস্থ হলে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। এছাড়াও ধান বাঁচাতে সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে প্রতিবছর নির্মাণ করা ফসল রক্ষা বাঁধ। এ বাঁধের কারণে হাওরে মাছের চলাচল ব্যাহত হয়, প্রজনন কমে গিয়ে বিলুপ্তির পথে অনেক প্রজাতি। কেবল বাঁধ নয়, হাওরে ধানের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বিল সেচে মৎস্য নিধন ও নির্বিচারে পোনা মাছ ধরার কারণেও রয়েছে বলে জানায় মৎস বিভাগ।
তাহিরপুরের জেলে সুকান্ত বর্মন জানান, হাওরে এখন মাছ নেই। মৎস্যসম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহ কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ধান ও মাছ দুটোর ব্যাপারেই মনোযোগী হওয়া উচিত। যে জায়গায় ধান হয় সেখানে ধান চাষ করতে হবে। আর যে জায়গায় ধান হয় না, অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সেখানে ধান চাষ না করে মাছ চাষে মনোযোগী হতে দায়িত্বশীলদের গুরুত্বসহ কাজ করতে হবে।
তাহিরপুরের সংবাদকর্মী শামসুল আলম আখঞ্জী টিটু বলেন, বোরো ফসল রক্ষায় বাঁধের মাটি বৃষ্টির সাথে হাওর ও বিলে যাচ্ছে। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মাটি জমছে হাওরে। ফলে বিলে পানি বেশি সময় থাকছে না। অদূর ভবিষ্যতে তো বিলগুলোই থাকবে না, সব সমতল ভূমি হয়ে যাবে। ফলে ধান ও মাছ দুটোরই ক্ষতি হবে।
তাহিরপুরের মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন জানান, প্রতিবছর মার্চের দিকে ঢল আর ভারি বৃষ্টিতে হাওর এলাকায় অকাল বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় ফসল। ঢলের পানি যাতে হাওরে প্রবেশ করে ধানের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। ফসল রক্ষায় নির্মাণ করা এই বাঁধের কারণে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের কারণে মাছ নদী থেকে হাওর বা বিলে যেতে পারছে না, পানিতে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারছে না। এ কারণে হাওরে মাছের সংখ্যা কমে এসেছে।