‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামকে অন্তরে রাখতে হবে’ : ফরিদা আক্তার
লেখা ও ছবি : জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. বাবুল হোসেন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ জলের পাড়ের মেয়ে। নবীগঞ্জ উপজেলার ‘কদম রসূল দরগাহ শরীফ’র খাদেম পরিবারের সন্তান। নাম ফরিদা আক্তার। জন্ম ১৯৫২ সালে ২৩ মে। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান নেতা ও উর্দুভাষী পরিবারের সন্তান হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ডিআইটি মার্কেটে যে সভা করেছেন, তেজস্বী মেয়ে-মোটে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ফরিদা আক্তার তাতে বক্তৃতা দিয়েছেন। চার বছর পর ক্লাস টেনের কিশোরী ফরিদা ছয়দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ছাত্রলীগের এই মেয়ে কর্মীটি জানতেন, ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। তখন নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে পড়েন। শহরে ছয়দফার পক্ষে ছাত্রী ও নারীদের অংশগ্রহণ এবং সমর্থনে মূল ভূমিকাটি পালন করেছেন। পরের বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিপক্ষে পূর্ববঙ্গের মানুষের টানা আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়-১৯৬৭ সালে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা। মহাগুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্বে আইয়ূববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তখন নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজে পড়েন। এখন সেটি সরকারী। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালির ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’র নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েছেন বরণ্যে মানুষটি। নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের ভিপি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ফরিদা আক্তার। ১৯৭৪ সালে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা, এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছেন দফায়, দফায় এগিয়ে। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ (বাকশাল)’র প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নারী কমিশনার।
বরেণ্য, এই কীতিমান গড়ে তুলেছেন এনজিও। তার বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাটির নাম ‘মহিলা সংঘ’। সেখানে জীবনমান বদলে গিয়েছে হাজারো নারীর। তারা শতাধিকের চেয়ে বেশি যোগ্য নারীর চাকরি দিয়েছেন। মহিলা সংঘের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করেছেন হাজারো মানুষকে। এই মেয়েদের জন্য তারা প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। বিশ্বের মোট ১শ ৩৮টি দেশে যাবার অভিজ্ঞতা আছে মহিলা সংঘের নিবাহী পরিচালকের।
মহিলা সংঘের প্রধান ফরিদা আক্তার ‘বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (বিএফটিইউসি)’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। নারী শ্রমিকদের দাবী, দাওয়া ও অধিকার আদায়ে তাদের অনেক সাফল্য আছে। কাজ করেছেন মহিলা অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব সরকারী অফিসে। ইউএনডিপি বা জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সংস্থা তাকে নিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়েদের ভুবনে। এই দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমজীবি নারীদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন তারা। তার একটি বিদ্যালয়ও আছে ‘কেয়ার কিন্ডারগার্টেন স্কুল’।
আজীবন কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে, নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের অন্যতম কন্ঠ, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তার অনেক সম্মান লাভ করেছেন। জয় করেছেন ‘জয়িতা পুরস্কার’, ‘সেরা সমবায়ী পুরস্কার’ ও ‘বেগম রোকেয়া পদক’। আজ শুক্রবার তিনি হাজার কাজ ফেলে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবনার একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এর এই আয়োজন ছিল তাকে ঘিরেই। শিরোনাম ‘পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান’। তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। সভাপতিত্ব করেছেন তাদের প্রথম নারী উপাচার্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্লু ছাত্রী, বরেণ্য গবেষক ও এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের নির্বাচিত সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস. এম. মোস্তফা কামাল খান।
জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. বাবুল হোসেন আরো জানিয়েছেন, ‘আমাদের নারী মুক্তিযোদ্ধা ও এনজিও ব্যক্তিত্ব ফরিদা আক্তারের বিশেষ স্মৃতিচারণ ও সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানটি বিকাল ৪ টায় শুরু হয়েছে। হয়েছে গ্যালারি ২-এ। শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ৬ টায়।’
প্রধান অতিথি বাংলাদেশের অন্যতম এনজিও ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ও ও নারী মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আক্তার বলেছেন,“বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’র মাধ্যমে বাংলাদেশ জেগে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধে এই বাঙালি জাতি একত্রে মিলিত হয়েছিল। হাজারো মা-বোনেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন, ঐতিহাসিক ও মহাকাব্যিক। আমাদের সাহস ও শক্তির উৎস।”
নতুন প্রজন্মের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের প্রথম ভিপি, মুক্তিযোদ্ধা ও মহিলা সংঘের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘আপনাদের সবার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বসবাস করতে হবে।’
তিনি বলেছেন, ‘সামনে তাকাতে হলে আমাদের পেছনের ইতিহাসকেও স্মরণ করতে হয়।’
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ আয়োজনে প্রধান অতিথি তার মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক এবং কর্মভুবনের সহযোদ্ধা, মাঠকর্মীদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন।
ফরিদা আক্তার বলেছেন, ‘আমাদের একাত্তরে কোনো কিছুর পরোয়া না করেই, বিন্দুমাত্র না ভেবেই মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। তারা জীবন দিয়েছেন ও এই বাংলাদেশ আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করি।’
তবে ফরিদা আক্তার আফসোস করেছেন, ‘সঠিক তথ্যভান্ডার ও নানা সীমাবদ্ধতার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে মূল্যায়ন না পেয়েই চলে গিয়েছেন। তাদের জন্য কিছু করতে হলে এই দেশকে ভালোবাসতে হবে। বাংলাদেশকে গড়ে তোলায় অবদান রাখতে হবে।’
শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘নবীন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ উপলব্ধি করতে হবে।’
‘তোমাদের দেশ গড়ায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে হবে’ তরুণ শিক্ষাথীদের বলেছেন।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন এই অনুষ্ঠানের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন ‘আজ বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এনজিও ব্যক্তিত্ব ফরিদা আক্তারের আগমন উপলক্ষ্যে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।’
অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন বলেছেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশি পাঠ ও আলোচনা করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম আমাদের বীরত্বগাঁথা, সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস জানতে পারবে।’
ড. হাফিজা খাতুন বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামকে অন্তরে রাখতে হবে।’
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচায জানিয়েছেন, ‘আমাদের সংগ্রামী, জয়ী এবং পরাজিত বীরদের ইতিহাস জানতে হবে। তাদের জীবন অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে এই সংগ্রামী মানুষদের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ ও দশের জন্য কাজ করতে পারব।’
উপ উপাচার্য ও বিশেষ অতিথি অধ্যাপক ড. এস. এম. মোস্তফা কামাল খান “পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান’-এ বলেছেন, ‘বিভক্তি ও বৈষম্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যায় এই জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের মাঝে কিছু বিষয়ে বিভক্তি চলছে। মতভেদগুলো ভুলে দেশ ও জাতি গঠনে সবাইকে কাজ করতে হবে।”
‘পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান’র উপস্থাপক ছিলেন মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রায় সবাই জন্মদিন পালনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানমালার এই বিশেষ আয়োজনে অংশ নিয়েছেন।
ছবি : পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছয় ও ১১ দফার অন্যতম কমী, রাজনৈতিক সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা এবং এনজিও ব্যক্তিত্ব ফরিদা আক্তারকে সম্মাননা স্মারক উপহার দিচ্ছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন ও উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস. এম. মোস্তফা কামাল খান। আলোচনা করছেন মুক্তিযুদ্ধ ও ফরিদা খাতুনের ওপর নারী মুক্তিযোদ্ধা উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন।
ওএস।