মন টানলে বিকেল কাটিয়ে আসতে পারেন গোলাপে
‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’ ফিরতি পথ ধরলো সাভারের শ্যামপুরের গোলাপ গ্রাম থেকে। সেই শুরু থেকে বৃত্তান্ত লিখে, ছবি দিয়ে পাঠিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
তারিখটি মনে আঁকা-১৭ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্যামপুর গ্রাম। এই পথে ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরা গাড়ী হাঁকালাম জেনে। চালকের আসনে আমি নিজেই। চিপা গলি পেরিয়ে মহাসড়কে, দূর পাল্লার যানবাহনকে ছাড়িয়ে, আমরা যাই এগিয়ে। মনে শুধু ভয়-চাকা না হয় পাংচার। একে আমি মহা ভয় পাই।
সেটি হলো না। পথে ভয় কাটছে দর্শনে। আমাদের গাড়ি চলছে। সাভার বাজার পেছনে ফেলে, ঢাকা-সাভার মহাসড়ক থেকে ডানে মোড় নিয়ে সি.এন.বি সড়কে ছুটছি। এই সরু পথে ফিটনেসহীন গাড়ির চেয়েও মহা ভয়ঙ্কর অটো রিক্সা। ওদের জ্বালায় কিছুটা ভীতু আমরা। আক্রাইনের মোড় থেকে শুরু হলো আরও বেদনাবিঁধুর পথ। এসেই যখন পড়েছি, আর কী করা?
দেশের বড়, বড় নাম করা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো এখানে। অথচ সড়কের কী বেহাল দশা? একেই বলে ‘বাতির নীচে আঁধার’। তবে দে-ছুটের বন্ধুরা ঠিকই অন্ধকারে আলোর ঝলক খুঁজে নিতে পারে। তাই হলো। ভাঙা সড়কে দোল খেতে, খেতে কিছুটা পথ এগুতেই নৈসর্গিক সব দৃশ্যপটে চোখ আটকাল।
অসাধারণ। ঢাকার পাশেই এমন মায়াবী প্রাকৃতিক দৃশ্য? চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না। সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে পেতে, পেতেই চোখে পড়ল লাল গোলাপ। বিশাল বাগান জুড়ে ফুটে আছে অসংখ্য। গাড়ি পার্ক করেই ছুটলাম সবাই বাগানগুলোর ভেতর একে, একে। ইয়া খোদা-এ দেখি বিশাল লাল গোলাপের সমুদ্র। তার মাঝে আমরা অতিকায় এক ক্ষুদ্র প্রাণী।
যতই এগিয়ে যাই, ততই অপার্থিব ভালোলাগা ভর করে মনে। এই রাজ্য হলো গোলাপের, বাগানের পর বাগান আছে। মাথায় নেশা চেপে বসল। কিসের গাড়ি আর কিসের বাড়ি? সবই ঠুনকো। বাড়ি-গাড়ির চিন্তা বাদ দিয়েই তো চলেছি। ফলে গোলাপের ভেতর থেকে ভেতরে ঢুকতে থাকলাম।
যতই এগিয়ে যাই, ততই গোলাপগুলো আপন হতে থাকে। প্রথম বাগানে যে আঁটির দাম ছিল ৪শ, বাগানের লোকেরা আপন হতে, হতে এখন পারলে ফ্রি গছিয়ে দেন।
আগে ধারণা পেয়েছিলাম, সাভার শ্যামপুর নামের গোলাপ গ্রামের গোলাপ চাষীরা বাগান বাঁচাতে একটু উগ্র হয়ে গিয়েছেন। ফলে সাভারবাসীরা তাদের টুঙ্গুইরা বলে থাকেন। তাদের গ্রামের আগের নাম টেঙ্গর শ্যামপুর। তবে আমরা পেয়েছি উল্টো প্রমাণ। কথায় আছে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো। হাঁটতে, হাঁটতে পেয়ে গেলাম, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব গাছগুলোকে। ওরা সব ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তারা তাল গাছের সারি। আমাদের দলের জসিমের চোখে ধরা পড়লো, রসের হাড়ি ঝুলছে তালের গাছে। হানিফ বললো, রস খাবে। আর জিগায়? চল যাই, গাছের তলায়।
দুঃখের বিষয়, তালের রসের স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে আবারও সাতসকালে। কী আর করা? এক সফরে তো আর সব মিলে না-মনকে বলি আমরা। ওরকম আশা করাও ঠিক নয়, প্রাণকে বোঝাই। ফলে গাছির মোবাইল নম্বার নিয়ে আরো এগুই। এবার চোখ পড়লো, ঝাঁকায় ঝুলে আছে গ্রামের চাষী বউয়ের লাউ, মাটিতে শুয়ে আছে মিষ্টি কুমড়া। সেসব দেখে আমাদের পথ চলেছে।
ঘুরতে, ঘুরতে দেখা হয়ে গেল, গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আবদুল খালেকের সঙ্গে। জানালেন, এই টেঙ্গর শ্যামপুর গ্রামেই ২০ বছর আগে প্রথম গোলাপ চাষ শুরু করেন গোলাম রসুল। তার বাগান করা দেখে ধীরে, ধীরে গ্রামের অন্যরা লাভজনক পেশায় অনুপ্রাণিত হয়ে গোলাপ ফুল চাষে এগিয়ে এলেন। শ্যামপুর গ্রামের প্রায় ৬০ পাকি [১৫,৬০ শতাংশ] জমিতে এখন গোলাপ চাষ হয়। রাজকীয় ফুলটি চাষ এই গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিরুলীয়া ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামেও প্রসারিত হয়েছে দারুণভাবে।
বছরের ১২ মাস তাদের গোলাপ চাষ হয়। ভর সন্ধ্যায় ফুল বিক্রির বাজার বসে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা গোলাপ ফুল কিনতে আসেন। দর্শনার্থী, ক্রেতাদের জন্য ফুল চাষীরা গড়ে তুলেছেন নিরাপত্তাবলয়ও। ফলে সব দেখে মাগরিবের নামাজ শেষে, সবুজের বারোভাজা খেয়ে আমরা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ ফিরতি পথ ধরি। ইচ্ছে হলে একটা বিকেল কাটিয়ে আসতে পারেন পুরো পরিবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে।
যোগাযোগ : ঢাকা থেকে উত্তরা দিয়ে, মিরপুরের বেড়িবাঁধ বা গাবতলী থেকে সাভার উপজেলার বিরুলীয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্যামপুর গ্রামে যাওয়া যায়। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড হতে বাসে বা লেগুনা। সেক্ষেত্রে কয়েকবার যাবাহন বদল করতে হবে। উত্তরা বা মিরপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে নিজস্ব গাড়ী নেই-এই অবস্থায় যেতে চাইলে কয়েক দফা গাড়ি বদল করে বিরুলিয়া ব্রিজ দিয়ে চলে যেতে পারেন গোলাপের গ্রামে।
খাবেন কোথায়? আক্রাইন বা দোসাইদ বাজারে মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট পাবেন। বিকালের নাশতার জন্য দোসাইদ বাজারে রাবেয়া খালার বানানো হরেক পদের ভর্তায় চিতই, ভাপা ও মালপোয়া পিঠা খাবেন। আছে অন্য দোকানে দুধের চা।
ওএস।