গবেষণার তীর্থকেন্দ্র ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর’
বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। আলাদা ভবন, বিশাল সংগ্রহশালা, নানা সেল দিয়েছে বিশিষ্টতা। জন্মের প্রথম দিনের প্রদর্শনী ও তারপর থেকে ক্রমাগতভাবে ছাত্র, ছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দানে গড়া এই জাদুঘর নিয়ে লিখেছেন ও ছবি দিয়েছেন জুনায়েদ খান
আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সবুজের চাদর মোড়ানো এক ক্যাম্পাস। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও পুরোনো। সরকারী। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে। হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে। কোলাহল কেবল ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকদের। বনবনানী ও পাখপাখির। বিরাট বড় বিশ্ববিদ্যালয়টি ২ হাজার ১শ একর। পাহাড় ও সমতল। আকাশের সঙ্গে মিতালী পাহাড় ছোঁয়া গাছগুলোর। পর্বতের বুক চিরে নেমেছে স্বচ্ছ ঝর্ণা। লেক, উদ্যান, হরেক জাতের স্থানীয় পাখি, বিলুপ্তপ্রায় নানা জীবজন্তু আছে। ফলে জ্ঞান ও প্রকৃতির দারুণ মেলবন্ধন আমাদের অনন্য করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা তীর্থকেন্দ্র করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর’।
জন্ম প্রথম দিন-১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। ২৪টি প্রত্নসম্পদের প্রদর্শনী হয়েছে। চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান-মিউজিয়াম অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তানের সভাপতি, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মমতাজ হাসান তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ দান করলেন বিভাগের প্রথম ও প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ২৪টি প্রত্নরাজি নিয়ে শুরু হলো প্রদশনী, জন্ম হলো অনন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও তার জাদুঘরের। বলাই হলো না, আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চট্টগ্রামের পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, চুয়েট (চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি)’র জনক; সালাউদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী।
প্রথম উপাচার্য ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক ড. এ. আর. মল্লিক (আজিজুর রহমান মল্লিক)। তার পৃষ্ঠপোষকতায়, আরেক বিখ্যাত ছাত্র ও উপাচার্য ও ইতিহাস বিভাগের রিডার অধ্যাপক ড. আবদুল করিমের প্রচেষ্টায় শুরু হলো ঐতিহাসিক জাদুঘরের। তারা ইতিহাসের প্রথম বিভাগের ছাত্র, ছাত্রী ও নবীন অধ্যাপকদের ফিল্ড সার্ভে বা মাঠ জরিপ গবেষণার কাজে পাঠাতে শুরু করলেন। আস্তে, আস্তে এভাবে শুরু হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর। সবই ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দান।
১৪ জুন ১৯৭৩ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর বেশ প্রত্নসম্টদ ও ইতিহাসের মূল্যবান নির্দশন নিয়ে চালু হলো। আমরাই বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। পরিচালনা করেন শিক্ষকরা। জাদুঘর দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। কথা বলে জেনেছি, তালিকাতে মোট দুই হাজারের বেশি অমূল্য ও অনন্য সংগ্রহ আছে এখন।
অ্যাকাডেমিক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজে সবই ব্যবহার করা হয়। মানবেতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, গবেষণা, সংগ্রহ কার্যক্রমে শিক্ষার্থী, গবেষক, অধ্যাপকদের সাহায্য এবং উৎসাহ দিয়ে চলে অবিরত। আছে প্রত্নতত্ব, ইতিহাস, প্রাচীন শিল্পকলা। নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে এখানে সংরক্ষণ প্রদর্শন ও গবেষণায় ব্যবহার করা হয়।
স্থায়ী সংগ্রহ ১শর বেশি। আছে-প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন, কাঠের জীবাশ্ম, প্রত্নভাস্কর্য, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুরের প্রত্নসম্পদ,প্রাচীন ও মধ্যযুগ, প্রাচীন, মধ্যযুগ, সুলতানী আমল ইত্যাদি, লোকশিল্প, ইসলাম, সমসাময়িক, ব্রিটিশসহ নানা আমলের মুদ্রা, নানা ঐতিহাসিক শিলালিপি, মূল্যবান ও দুর্লভ বই, পান্ডুলিপি, টেরাকোটা, পুরোনো, মূল্যবান ধাতব শিল্পকর্ম, চীনামাটির বাসন, গাত্রালঙ্কার, আদিবাসীদের অলংকারসহ ব্যবহার্য, কালুরঘাট ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলাদি; একাত্তরের পোস্টার, মূল্যবান পুস্তিকা, সংবাদের কাটিং, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবান প্রকাশনা, প্রশাসনিক দলিল ও নথি। আগ্রহীরা নিয়ম মেনে ও যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। নাসিরাবাদ পাহাড় থেকে যোগাড় করা টারশিয়ারি আমলের মাছের কংকালটি আমাদের সবচেয়ে পুরোনো সম্পত্তি। এখন মোট ১২ হাজারের বেশি নানা ধরণের মূল্যবান সামগ্রী বেঁচে আছে এখানে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার’র পাশে ছোট্ট টিলার ওপর দোতলা একটি সাদা বিরাট ভবনই হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। অসাধারণ সুন্দর বাগান আছে। দেখার আমন্ত্রণ রইলো। নীচতলায় গবেষণা কেন্দ্র, আলোকচিত্র সংগ্রহ, কনজারভেশন ল্যাবরেটরি, প্রদর্শন কক্ষ, সেমিনার, ডকুমেনটেশন সেল, স্টোর রুম, কটি অফিস রুম ও চট্টগ্রামের বরণ্যে সন্তান আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ গ্রন্থাগার আছে। তাতে সাহিত্য বিশারদের সংগ্রহ করা পুথি সাহিত্য স্বযত্নে রক্ষিত। আছে তার প্রাচীন বাংলার তালপাতা, তুলট কাগজে লেখা পুঁথিও।
গ্যালারিগুলো হলো-‘প্রাগৌতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক’, ‘প্রাচীন ভাস্কর্য’, ‘ইসলামিক শিল্পকলা’, ‘লোকশিল্প ও সমকালীন শিল্পকলা’। সবগুলোই নীচতলায়। এগুলোতেই প্রদশনী হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, ছাত্রী, গবেষক ও উপাচার্যরা সবাই বিশেষভাবে জাদুঘরের যত্ন নিয়েছেন। তাদের অনেকের হাতে গড়া গাছের সারি, ফুলের সারিও আছে। ছাত্র, ছাত্রীদের বসার জন্য উন্মুক্ত মঞ্চটি দর্শক গ্যালারি হিসেবে জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত। অনেকে পার্ক মনে করেন।
প্রাগৌতিহাসিক ও প্রত্নতিাত্বিক গ্যালারিতে আছে মাছের ফসিলটি, উপহার পাওয়া। প্রাচীন চাঁটগার প্রাকৃতিক ইতিহাস ও গবেষণার সম্পদ। আছে ২০ হাজার বছরের পুরোনো কাষ্ঠখন্ড, কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা ৭ম সতকের আলোর বাতি, সোমপুর বিহারের পোড়া মাটির ফলক, ধাতবচিত্র, কাদা মাটিতে গড়া মূর্তি প্রভৃতি।
প্রাচীন ভাস্কর্য গ্যালারির প্রধান আকষণ ব্রাক্ষণ রাজরাজা ও বৌদ্ধদের শাসনামলের মূর্তি।
এই সংগ্রহ সেই সময়কালগুলোর মানুষের বিশ্বাস, রীতিনীতি, সংস্কৃতির। আরো আছে অলংকার।
৩২০ থেকে ৫৫০ শতকের গুপ্ত সম্রাজ্যের আমলে গড়া একটি সূর্য মূতি এই জাদুঘরকে করেছে বিশিষ্ট। এছাড়াও মোট ৫২টি নানা সময়ের মূল্যবান কষ্টিপাথরে গড়া পূর্তি আছে। অত্যন্ত দুস্পাপ্য। আছে মোট ২৮টি ব্রোঞ্জ, ধাতব মূর্তি। বেশিরভাগ ৮ থেকে ১২ শতকের পাল রাজাদের আমলে গড়া। তাদের সময়ে মাটির মূর্তিও আছে বেশ। আছে হিন্দু বৈষ্ণব, দেবতা শিব, শাক্ত জনগোষ্ঠী ও গণপতি দেবতার মূর্তি। মিরসরাইয়ের ৯ শতকের পাথরের রাধাকৃষ্ণ মূর্তি আছে। কাঠের ভাস্কর্য আছে।
‘ইসলামিক শিল্পকলা’র মধ্যে আছে হাতে লেখা প্রাচীন কোরআন, উমাইয়া আমলের মুদ্রা, মসজিদে খোদাই কারুকার্য, সুলেমানি আমলের নকশা, মোঘল বাদশা আলমগীরের আলমগীর নামার দুর্লভ কপি, ১২২৯ থেকে ১২৩৬ সালের মধ্যে রচিত ফরাসি ভাষায় লেখা একটি বিয়ের কাবিননামা, ১০৬১ সালে লেখা মিফতাহুস সালাতের কপি, সম্রাট শাহজাহানের ব্যবহার করা যুদ্ধের কামানের ওপরের অংশ, তাদের মোঘল আমলের তলোয়ার ও ঢাল, সুলতানী আমলের স্বর্ণ, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি। মুদ্রা সংগ্রহ খুব ভালো ও সমৃদ্ধ। আছে মূর্তজা বশীরের মুসলিম ক্যালিওগ্রাফি। এই সংগ্রহগুলো বিভিন্ন সময়ের মুসলিম সভ্যতা, তৎকালীন জীবনধারা, রাজনীতি, অথনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সার্বিক চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
লোকশিল্প গ্যালারিতে কালের গর্ভে বিলুপ্ত শিল্পীর তৈরি বাঘের মাথা, সিরামিক দ্রব্যাদি, রাজার দন্ড, নানা সময়ের অলংকার, গ্রামোফোন, শীতল পাটি, চরকা, তাঁত, পালকি ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যাবে। ১৭ থেকে ১৮ শতকের মূল্যবান কাদামাটির ভাস্কর্য, আদিবাসীদের নানা সামগ্রী ও অলংকার আছে। গ্যালারিটি বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্যের অনন্য সংগ্রহকেন্দ্র।
সমকালীন শিল্পকলা গ্যালারিতে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপকদের কাজ। আছেন অধ্যাপক রশীদ চৌধুরী, মূর্তজা বশীর, সাবিহ-উল-আলম। তারা এনেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, এস. এম. সুলতান, কামরুল হাসান, নিতুন কুণ্ডু, হাশেম খানের কাজ। অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদের ভাস্কর্য আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর সংরক্ষণ করেছে প্রাচীন আমলের দুর্লভ সংস্কৃত, ফারসি, পালি, আরবি, বাংলা পান্ডুলিপি, নথি। দুস্প্রাপ্য বই, পুস্তিকা, পোস্টার, সাময়িকী, পত্রিকার মূল্যবান কাটিং । মরিচ গাছের পাতায়, পুরনো কাগজে লেখা প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি পান্ডুলিপির ৯৮ টুকরোগুলো দক্ষ অনুবাদকের অভাবে এখনো পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। জেমস রনেলের লেখা ‘হিন্দুস্তান-মোঘল অ্যাম্পায়ার’ তার ‘বেঙ্গল ম্যাপ’টি আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কর্ণারে আছে যুদ্ধের দুর্লভ চিঠিগুলো, দলিলাদি, স্মারক, নথি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর স্বযত্নে তার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সন্তানদের নিয়ে নানা স্মারক, তাদের সবাইকে নিয়ে প্রকাশিত লেখাগুলো সংরক্ষণ করে। জাদুঘরের সব সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষক, অধ্যাপক, ছাত্র, ছাত্রী, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা রচনা, গবেষণা ও জ্ঞানের জন্য ব্যবহার করেন। ছাত্র, ছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার জন্য ফ্রি। খোলা থাকে অফিস সময়কালে। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের গুরুত্ব জানানো ও ব্যবহারে অনন্য সংগ্রহশালাটি অ্যাকাডেমিক সব কাজে দারুণ সহায়ক।
নিয়মিতভাবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, জাদুঘর দিবসে আলোচনা ও প্রদর্শনী, বিশেষ ব্যক্তিত্বদের আগমনে প্রদর্শন কাযক্রম পরিচালনা করেন তারা। আছে সব প্রদর্শনী সামগ্রীর তালিকা, লিফলেট, বই। ভাস্কর্যগুলো নিয়ে আলাদা একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ ছাপাখানায় প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। জাদুঘরটি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিক এক অনন্য, অনুপম কেন্দ্র।
ক্যাপশন : ১. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ভবন। ২. জাদুঘরের পথ নির্দেশক। ৩. ফোকলোর গ্যালারি। ৪. মহামূল্যবান প্রাচীন ভাষ্কর্য। ৫. অমূল্য ভাষ্করের গড়া ৫. দুর্লভ রাজকীয় সিংহাসন। ৬. সম্রাট শাহজাহানের কামান। ৮. সুলতানী আমলসহ নানা সময়ের মূল্যবান স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা। ৭. জয়নুল আবেদিনের কাজ ও ৯. প্রত্নতাত্বিক সংরক্ষণ গবেষণাগার।
ওএস।