ড. সোলায়মানের কৃষিতে ‘সৌর আলোর ফাঁদ’
বাংলাদেশের প্রখ্যাত কৃষি অধ্যাপক শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ব বিভাগের নামকরা মধুবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান ও তার দল আবিষ্কার করেছেন কৃষকদের বাঁচাতে সৌর আলোর ফাঁদ। জমির ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের উন্নততর প্রযুক্তি। দারুণ এই আবিষ্কারটি নিয়ে লিখেছেন ও ছবি দিয়েছেন তার ছাত্র রবিউল ইসলাম রাকিব
ফসলি জমির নানা ধরনের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ ও ফসল উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন কম্পানির কিটনাশক ব্যবহার করেন বাংলাদেশের কৃষকরা। তাতে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, ফসলের ও জমির যে ক্ষয় ঘটে, সেসব নিয়ে কৃষিবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের অনেক কাজ আছে। তবে একেবারেই প্রাকৃতিক এক নিরোধ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন ঢাকার একমাত্র কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় ‘শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’র অধ্যাপক ও ছাত্র, ছাত্রীরা। অভিনব এই ক্ষতিকর পোকা দমন পদ্ধতির নাম দিয়েছেন তারা ‘সোলার ইনসেক্ট লাইট ট্যাপ’। বাংলায়ও নামটি খুব সুন্দর ‘সৌর আলোর ফাঁদ’।
ফাঁদটি পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর, যেভাবে কৃষকরা জমিতে চাষাবাদ করেন। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। তবে এটি একটি যান্ত্রিক কৌশল। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশের বিখ্যাত মধুবিজ্ঞানী ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান অন্যরকম এই গবেষণা দলের প্রধান। জানিয়েছেন, ‘পরিবেশবান্ধব সৌর আলোর ফাঁদের মাধ্যমে বাংলার কৃষকরা তাদের ফসলি জমিতে রাসায়নিক কিটনাশকগুলোর ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবেন।’ বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই মধুবিজ্ঞানী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন টাস্ট্র আমাকে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে।’
অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান বলেছেন, ‘আমাদের সৌর আলোর ফাঁদের মাধ্যমে সূর্যের আলোকশক্তিকে ব্যবহার ও ধারণ করে রাতের বেলাও এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও পুরুষ ও স্ত্রী জাতের নানা ধরণের ক্ষতিকর ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়কে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘পোকামাকড়ের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, তারা যেখানেই থাকুক না কেন আশপাশের আলোর দিকে উড়ে চলে। সেখানে থাকে। এই আচরণকে আমরা বলি ফ্যাকালটেটিভ বা অনুসঙ্গী আচরণ। তাদের এই আচরণটিকে ভিত্তি করেই সৌর আলোর ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। এখানে কোনো ধরণের সারের বালাই নেই, প্রয়োজন ও ব্যবহার নেই কোনোভাবেই। এর বাদেও সূর্যালোকের উপর ভিত্তি করে তৈরি বলে এই ফাঁদটি পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব। কৃষকরা খুব সহজে ব্যবহারও করতে পারবেন। তাদের জমির যেখানে প্রয়োজন স্থাপন করতে পারবেন। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করতে হবে। তাতে আছে সংযুক্ত ব্যাটারি। ফলে বৃষ্টি-বাদলাতেও এই সৌর আলোর ফাঁদ কাজ করে যাবে। চার্জ কন্টোল সার্কিটের মাধ্যমে সৌর প্যানেল ও ব্যাটারির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনে চার্জ দেওয়া যাবে বিদ্যুৎ শক্তি থেকে। ফলে কোনো সময়-বন্যাতেও ফসলের জমি নিয়ে কৃষকদের ভাবনা থাকবে না। আছে বিশেষ এলইডি লাইট, সেটি আলোর সংরক্ষণ করবে। এই বাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী বাল্ব হোল্ডিং ফানেল আছে। ব্যাটারির জন্য বিশেষ বক্স রেখেছি আমরা। এলইডি লাইটটি প্লাস্টিকের বালতির মুখের প্রায় সামনে বলে সেখানে জালের মধ্যে পোকামাকড়গুলো এসে আটকে পড়বে। রাতের বেলা এই সৌর আলোর ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। দিনে চার্জ নেবে সৌর শক্তির।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রতি একর বা ২০ কাঠা জমির জন্য একটি মাত্র সৌর আলোর ফাঁদ যথেষ্ট বলে কৃষকের জন্য দারুণ সাশ্রয়ী।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, সৌর আলোর ফাঁদ নামের এই বিশেষ আবিস্কারের মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্তত পক্ষে ৫ ভাগ আর ভালোভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকায় ভর্তি জমির ক্ষতি কমিয়ে এনে ফলন ৫০ ভাগও বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এর বাদেও ধান, ভুট্টা, শাকসবজির জমিতে রাসায়নিক পেস্টিসাইডের ব্যবহার ২৫ থেকে ১শ ভাগ পর্যন্তও কমানো সম্ভব হয়েছে। এমনকি আম গাছের মতো বড় আকারের গাছগুলোতেও খুব ভালোভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সৌর আলোর ফাঁদ। তাতে এই ফসলের ফলন বাড়ানো গিয়েছে ৫০ ভাগও। আমে পোকামাকড় কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। এই জাতের ফলের গাছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ রাসায়নিক স্প্রের ব্যবহারও কমানো সম্ভব হয়েছে। নিয়মিত সৌর আলোর ফাঁদে একসময় আর কোনো ধরণের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করতে হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম নামকরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী অধ্যাপক ও গবেষক এবং আবিস্কারক।
অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান আরো বলেছেন, ‘ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা কৌশলে এই প্রযুক্তিবান্ধব, সহজ ও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আবিষ্কারটি নব দিগন্তের সূচনা করবে। এই খাতে কৃষকের দুশ্চিন্তা ও আর্থিক আগে-পরের ক্ষতি ধীরে, ধীরে দূর করা যাবে।’
অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান বলেছেন, ‘কিটনাশক ব্যবহার করলে দিনের বেলায় যেসব পোকামাকড় মানুষের ফসলের জমি ও খাদ্যপণ্য উৎপাদনে সাহায্য করে তারা নির্বিচারে মারা পড়ে। ক্ষতিকর পোকারা দিনে লুকিয়ে থাকে। দিনে পোকামাকড় তেমন মারতে হয় না। তখন তারা ফসলের উৎপাদন বাড়াতে স্প্রে করেন বা সার দেন। কিন্তু পোকা না থাকলে আর স্প্রের বা সারের দরকার তেমন নয় না। ফলে কৃষকদের সৌর আলোর ফাঁদের বাংলাদেশী বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বাঁচানো সম্ভব হবে। এর বাদেও চাইলে কৃষকও রাতের ক্ষতিকর পোকাগুলোকে জমিতে তাদের পরিমাণ ও নমুনাগুলো দেখতে পারবেন। কেননা তখন তারা একমাত্র আলোর ফাঁদটি দেখে নির্বিচারে সৌর আলোর ফাঁদে পা দেবে। এরপর দিনের বেলা ও চাইলে ভোর রাতে বা প্রয়োজনানুসারে তাদের বন্দী করবেন কৃষক। দিনে যে চার্জ নেবে এই সৌরশক্তির ফসল প্রযুক্তি, রাতে সে তা ব্যবহার করে কৃষকের ফসল বাঁচাবে। পরদিন সৌর আলোর ফাঁদের মাধ্যমেই কৃষক জমিতে কাজ করতে পারবেন। ব্যবহারের ফলে একসময় আর ব্যবহার করতে হবে না কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক স্প্রে বা সার।’
ঢাকার পাশের মানিকগঞ্জের সদর উপজেলায় বাংলাদেশ সরকারের ‘বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়’র মাধ্যমে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অন্যতম আবিষ্কারটিকে সে উপজেলা কৃষি অফিসারের পরামর্শে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমিতে ২শ সৌর আলোর ফাঁদ স্থাপন করা হয়েছে কৃষকের সাহায্যে। এর বাদেও উদ্যানতত্ববিদ ও মধুবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান তার ছাত্র এই লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রাকিবকে জানিয়েছেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মানিকগঞ্জ ও ঢাকার মোট পাঁচ উপজেলায় মোট ১ হাজারটি সৌর আলোর ফাঁদ বিশেষ প্রকল্প হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে ফলাফল জানতে স্থাপন করেছে।’
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষি অফিস সূত্রে জানানো হয়েছে, সারা দেশে সৌর অলোর ফাঁদের এই কৃষি প্রযুক্তির সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। তাতে আরো অনেক বেশি কৃষক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিটি ব্যবহারের সুবিধা লাভ করবেন।
তারা নিশ্চিত করেছেন, সৌরচালিত ক্ষতিকর পোকামাকড় চিহ্নিত করার এই ফাঁদের নীচের অংশে প্লাস্টিকের চাইলে পাটের বা অন্যকোনো উপকরণেও করা যায়, বালতিতে পোকামাড়কগুলো জমা হয়ে থাকে। ফলে তাদের বিনাশ করতে পারেন কৃষক নিজেই। কেবল তাকে আধুনিক প্রযুক্তিটি কিনতে সামর্থ্যবান করে তুলতে হবে। সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণদান করতে হবে। সাহায্য করতে হবে এই মানুষগুলোকে যারা আমাদের খাবারের যোগান দেন।
তারা বলেছেন, এই সৌর আলোর ফাঁদ উন্নত প্রযুক্তিতে খুব ভালোভাবে তৈরি। পরিবেশের কোনো ক্ষতি তো করেই না, বরং কিটপতঙ্গের আক্রমণ রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হিসেবে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত কাজ করে যাবে। এই প্রযুক্তিটি একটি অনন্য আবিষ্কার ও কৃষকবান্ধব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বিনাখরচে তারা এর উন্নত গবেষণাও দাবী করেছেন। তাতে কৃষকের অনেক উপকার হবে প্রাথমিকভাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় এটি কাজ করবে। টেকসই কৃষি চাষ পদ্ধতি গড়ে উঠবে।
কৃষকদের সঙ্গে সরেজমিনে কথা বলে অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান জানিয়েছেন, ‘কেবল জমিতে খুঁটি পুতে, বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে সহজেই এটি স্থাপন করতে পারছেন কৃষকরা। তারা বেশ বুদ্ধিমান। উৎপাদন ও ক্ষতি না থাকায় বরং ক্ষতিকর পোকামাকড়গুলো নষ্ট করায় খুব লাভবান হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ সহযোগিতা তাদের শিখিয়ে দিলেই শিখে নিচ্ছেন।’ এই কাজে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের সহযোগিতা লাভ করছেন তারা। তাতে তাদেরও মাঠশিক্ষণ ঘটছে।
একজন কৃষক বলেছেন, ‘আমার সৌর আলোর ফাঁদে অনেক কিট ধরা পড়েছে। আমি খুব খুশি সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছেন ও পরিবেশের ক্ষতি বাঁচাচ্ছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘জমিতে কোনো ধরণের বিষ ব্যবহার না করায় জমির উবরা শক্তি বাড়ছে, পানির সঙ্গে মিশে পুকুরের মাছেরও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তাদের বংশ বাড়ছে। নিজের শরীরও ভালো থাকছে কিটনাশক প্রবেশ করতে না পেরে। ফসলও ভালো হচ্ছে।’
সবশেষে ‘সৌর আলোর ফাঁদ প্রকল্প পরিচালক’ অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান বলেছেন, ‘বিদ্যুত শক্তি খাত থেকে কাবন নি:সরণের হার হলো ৪৫ ভাগ। বেশিরভাগই জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে হয়। তাতে ক্ষতিকর কিটনাশক ব্যবহারে ফসল, মাটি ও পানি দূষণ ঘটে। কৃষকের নিয়মিত স্বাস্থ্যহানি হয়। টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য টেকসই পরিবেশ প্রয়োজন। সৌর আলোর ফাঁদের ফলে জলবায়ুর পরিবতন ঘটবে না, কার্বন ফুট প্রিন্ট কমে আসবে। দূর হবে।’
ছবি : সৌর আলোর ফাঁদের সামনে গর্বিত কৃষক, আবিষ্কারক ধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোলায়মান, স্থাপন করা হচ্ছে তাদের উন্নত, পরিবেশসহায়ক প্রযুক্তি।