পাল্লা দিয়ে বাড়লেও আদায় হচ্ছে না খেলাপি ঋণ
তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর এই সময়ে আদায় হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার কম। যা আগের প্রান্তিকের (মার্চ-জুন) অর্ধেকের কম।
অপরদিকে ঋণ আদায় সেভাবে না বাড়লেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তফসিলভূক্ত ৬১টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
অথচ আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই প্রথম দিন বলেছিলেন, ‘আর এক টাকাও খেলাপি বাড়বে না। কিন্তু চার বছর চলে গেলেও হুহু করে বেড়েই যাচ্ছে খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপির পরিমাণ এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
এর আগে, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিলে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা।
আদায়ের হার কম হওয়ার কারণে দেশে গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে। কারণ ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ টাকা।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও করোনায় আক্রান্ত হলে সরকার ব্যবসায়ীদের প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছিল। ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণ আদায় বন্ধ এবং ঋণ অবলোপনের সুযোগ দিয়েছে। এভাবে নানা রকমের ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক ঋণ গ্রহীতা এই সুযোগ নিয়েছেন। যে কারণে কাগজে তাদের নাম নেই। এ জন্য তাদের ঋণখেলাপি বলা যাবে না। তারপরও আদায় হচ্ছে না ব্যাংকের টাকা।
সর্বশেষ তথ্য মতে, গত ১৮ বছরে ব্যাংক খাতে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৯ মাসে নতুন করে অবলোপন করা হয়েছে ৯৭৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মতে, ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজার বুকে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অব নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে।
সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, সেই ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে এ ঋণ পুনঃতফশিল বা পুনর্গঠন করা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।
সূত্র মতে, সর্বশেষ তথ্য মতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে তফসিলি ৬১টি ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকে আদায় হয়েছে ৪৭০ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের আদায় এক হাজার ২০৪ কোটি, বিদেশে ব্যাংকের ৩৭ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকে নগদ আদায় হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যসব ব্যাংক থেকে আদায় হয়েছে ৬০১ কোটি টাকা।
অপরদিকে, আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) নগদ আদায় হয়েছিল ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকে আদায় হয়েছে ৫৩৯ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের আদায় ২ হাজার ৮৫১ কোটি, বিদেশে ব্যাংকের ৩২ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকে নগদ আদায় হয়েছে ৪৩৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যসব ব্যাংকের মাধ্যমে আদায় হয়েছিল ২৪১ কোটি টাকা।
ব্যাংকিংখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সার্কুলার ইুস্যু করেছে। এগুলো পরিপালন, প্রতিপালন করা হলে খেলাপি কমবে।
রাজনৈতিক কারণেই কি ঋণ বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে রাজনৈতিক সমস্যা নেই। গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে। তারা আয় করে ঋণ পরিশোধ করে। তবে বিভিন্ন কারণে অনেকে ঋণ খেলাপি হন, বাংলাদেশ ব্যাংক তখন পুনর্বাসন করতে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন পলিসি (নীতি) গ্রহণ করে। ঋণ আদায় করার জন্য গাইডলাইনও জারি করে। সেটি পরিপালন করা হলে খেলাপি ঋণ আদায় বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে বেনামে ঋণ নিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে দেশে। এ সব ঋণ আসলে কতোটা নিয়মের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ সব ঋণে নিয়মের যে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেনি, তা নয়। এ জন্যই তো দুইটা ব্যাংকে অবজারভার্ব নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্তকারী দল পরিদর্শন করেছে। তদন্ত করেছে।
খেলাপি ঋণের ব্যাপারে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, করোনাকালিন সরকার কিছু ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ সুদে ডাউন পেমেন্টে ঋণ সুবিধা দিয়েছে। সেই ঋণই অনাদায়ী হচ্ছে। এ জন্য খেলাপি বাড়ছে। আদায়ও তেমন হচ্ছে না। এ ছাড়া কিছু খারাপ লোকও ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছে না। এ জন্য খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আদায়ও কম হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে এ অবস্থার উন্নতি হবে না অর্থাৎ খেলাপি ঋণ কমবে না।
এনএইচবি/আরএ/