রাজধানীতে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য, সতর্ক না হলে জীবনের ঝুঁকি
বেশ কয়েকদিন আগে আনিসুর রহমান আনিস নামের এক ব্যক্তি প্রতিদিনের মতো কাওরান বাজার দিয়ে মিরপুরের বাসায় ফিরছিলেন। আনিস একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত। একদিন রাতে তিনি অফিস থেকে বের হয়েছেন সাড়ে ১০টার দিকে। তখন তিনি রাজধানীর কাওরান বাজার মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে গাড়িতে উঠার জন্য রাস্তা পার হন। রাস্তায় অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটে ফার্মগেটের দিকে যেতে থাকেন। ঠিক এমন সময় ৫-৭ জন ছিনতাইকারী তাকে ফলো করতে থাকেন। হঠাৎ করে অল্প বয়সি এক কিশোর তাকে ধাক্কা দেয় এবং চাকু মেরে দৌড় দেয়।
পরে এই চক্রের অন্যান্য সদস্যরা দৌড়ে এসে আনিসের শরীরে বিভিন্নভাবে আঘাত করতে থাকে। এ সময় তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলে ছিনতাইকারীরা তাকে জখম করে তার মোবাইল, মানিব্যাগ ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান। পরে আনিস কোনোমতে রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে কাওরান বাজারের মোড়ে চলে যান এবং অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সেখানে পুলিশ ও আশেপাশের লোকজন তার মাথায় পানি দেন। কিছু সময় পর তার জ্ঞান ফেরে। এরপর ঘটনাস্থলে ডিউটিতে থাকা এক পুলিশ সদস্য তাকে ১০০ টাকা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে একটি রিকশা ভাড়া করে পঠিয়ে দেন। আনিস এখন সুস্থ কিন্তু উদ্ধার হয়নি তার খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগে থাকা টাকা।
আনিসের মতো এমন অনেকেই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন এবং ছিনতাই চক্রের ছুরি, চাকু বা অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।
উত্তরা দিয়াবাড়ী মেট্রোরেল এলাকায় রাতের বেলায় ছিনতাইকারীদের হাত থেকে বেচেঁ যাওয়া নিঝুম মামুন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ঢাকায় দিন দিন বাড়ছে ছিনতাই, সতর্ক না হলেই যে কোনো সময় জীবনাটা চলে যেতে পারে।
অবশ্য, ছিনতাইকারীদের এ সব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এই সময়টাতে চুরি ,ছিনতাই, মাদকসহ ভিন্ন ভিন্ন কিছু অপরাধ বেড়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, এজন্য নগরবাসীদের আমরা আগে থেকেই সতর্ক করেছি। এবং আমরা জানিয়েছি ফাঁকা রাস্তায় কেউ একা একা চলাফেরা করবেন না। প্রয়োজনে পুলিশের সহযোগিতা চাইবেন। তবে যারা চুরি বা ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে অভিযোগ করেন তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে চুরি ,ছিনতাই রোধে কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। অভিযুক্তদের তথ্যের ভিত্তিতে ছিনতাইকৃত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন শ্রেণির অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
রাজধানীর মোহাম্মপুর, আদাবর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও তেজগাঁও থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৫২ জনকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর র্যাব-২ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মো. ফজলুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। এতে পথচারী ও এলাকাবাসীর মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীবাসী বিভিন্ন এলাকায় চলাচলের সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। নারী-পুরুষ, স্কুলগামী শিক্ষার্থীসহ সবাইকে এর কবলে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ সব ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অনেকেই জখম হচ্ছেন এবং মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করতে মাঠে নামে র্যাব-৩। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর মতিঝিল, মুগদা, ওয়ারী, খিলগাঁও, বংশাল, সবুজবাগ ও শাহজাহানপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই সংঘবদ্ধ চক্রের মূল হোতাসহ মোট ৬১ জনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ৬১ জনের মধ্যে ৩২ জনের চক্রটি উৎসব উদযাপনকে ঘিরে জনবহুল স্থান টার্গেট করে ছিনতাই কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। আর এর মধ্যে ২৯ জন ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা মেট্রোরেল ও নির্জন এলাকায় ছিনতাই করত। এদের দ্বারা অনেকেই জখম হয়েছে।
র্যাব জানায়, মতিঝিল বিভাগে যারা ছিনতাই করে তাদের অনেকের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। এবং তাদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। এরপর আমরা সারা ঢাকাতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করি। তথ্য আসে বড় কয়েকটি চক্র পৃথক পৃথক জায়গায় ছিনতাই করে থাকে। চক্রটি যেকোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে তাদের তৎপরতা বাড়ায় এবং ছিনতাইয়ের পরিকল্পনায় যুক্ত হয়।
তিনি বলেন, মতিঝিলে ছিনতাই চক্রের প্রধান হল- রাকেশ ও মান্নান। তাদের ২ জনকেই আমরা আইনের আওতায় এনেছি। অন্য কিছু সিন্ডিকেট বাইরে রয়েছে আশা করি তারাও গ্রেপ্তার হবেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ছিনতাইকারীরা খুবই দুর্ধর্ষ। তারা ছিনতাই করার সময় সাধারণ মানুষকে ব্লেড, ছুরি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে যেখানে সেখানে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। ছিনতাই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের অভিযান আমাদের চলমান রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, গত ২৪ ফ্রেরুয়ারি দিবাগত রাতে তেজগাঁও বিভাগের পানি ভবন সংলগ্ন ফুটপাত এলাকায় ফারুক হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ফারুখ হত্যার ঘটনায় ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ পুলিশ এ হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে জানতে পারে ফারুক ছিনতাইকারীদের দ্বারা জখম হয়ে মারা গেছেন।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন জন পেশাদার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এটি প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতাই বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরমধ্যে একাধিক খুনের মামলার আসামিও রয়েছে।
জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, তেজগাঁ এলাকায় ছিনতাইয়ের গ্যাং লিডার মো. সাদ্দাম হোসেন সাব্বির ওরফে সিটু সাব্বির ওরফে সাগরসহ তার অন্য সহযোগীদের আমরা গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারলাম এই চক্রটি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করত। ছিনতাইয়ের সময় তাদের বাঁধা দিলে তারা ধারালো চাকু মেরে পালিয়ে যায়। যাদের চাকু মারা হয় তারা যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পায় তাহলে অনেকেই মারা যায়।
ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকা থেকে ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে একটি চক্রের দলনেতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব-১ জানায়, ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সর্বস্ব ছিনতাই করতেন এই চক্রের সদস্যরা। এই চক্রের মূল হোতা এক যুবক তার নাম শরীফ হোসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজধানীর মেট্রোরেলের নির্জন রাস্তায়, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় ছিনতাই চক্রের তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। ছিনতাই চক্রের সদস্যরা নিরীহ মানুষকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বিভিন্ন মালামাল ছিনিয়ে নিচ্ছে। এ সব অপরাধে যুক্ত রয়েছে— কিশোর, অল্প বয়সী যুবক শ্রেণির লোক। তারা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলন্ত গাড়ি থেকে থাবা দিয়ে অথবা অন্ধকারে নির্জনে নিরীহ পথচারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
এদিকে মিতিঝিলে ছিনতাইয়ের কবলে পড়া সুমন হোসেন (শাহাদাত) নামের এক ব্যক্তি বলেন, রাতে গাড়ি না পেয়ে হাটছিলাম হঠাৎ পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন যুবক ও কিশোর আমাকে টার্গেট করেছে। আশেপাশে কাউকে না পেয়ে দেরি না করে দৌড় দিয়ে একটা দোকানে আশ্রয় নেই।
ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া মো. সাব্বির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাত ১২টার পর আগারগাঁও তালতলা দিয়ে মেট্রোরেলের লেনের নিচ দিয়ে হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলাম। এমন সময় তিন জন হিজলা আমাকে ডাকে। দূর থেকে দেখতে পেলাম তাদের সঙ্গে ওত পেতে আছে ৬-৭ জনের একটি দল।
সাব্বির বলেন, প্রথমে হিজলারা আমাকে দাঁড়াতে বললে আমি একটু দাঁড়াই। পরে ওই যুবকরা দৌড় দিয়ে এসে ছুরি ধরে আমাকে জিম্মি করে এবং আমার কাছে থেকে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে বিষয়টি জানালে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলেও টাকা এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়নি।
ছিনতাইকারীদের হঠাৎ তৎপরতা ও তাদের বিভিন্ন কৌশলের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিশেষ করে রাতে যারা বাসে চলাচল করেন বা গ্রাম থেকে যারা ঢাকাতে আসেন তারা বেশি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। এ সব বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে অনেকবার সতর্ক করেছি এবং বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষকে আমরা বলেছি আপনারা রাতের বেলায় একা একা চলবেন না। গভীর রাতে ঢাকায় ছিনতাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, তবে এ সব ছিনতাইকারীরা বেশির ভাগ ধরা পড়ার পরে জামিনে বের হয়ে বা পলাতক থেকে আবারও ছিনতাইয়ের কাজে যুক্ত হয়। ছিনতাইকারীরা বার বার গ্রেপ্তার হচ্ছেন। কিন্তু তারা সংশোধন হচ্ছেন না।
হাফিজ আক্তার আরও বলেন, ঢাকা রাতে বা ভোররাতের দিকে অরক্ষিত থাকে। ঠিক এই সময়টাতে ছিনতাই হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। বিশেষ করে রাতে নগরবাসী ও যাত্রীরা যারা চলাচল করেন তারা যদি বাসস্ট্যান্ডে বা টার্মিনালে নামার পর সকালের দিকে তাদের গন্তব্যে যান বা চলাচল করেন তাহলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। এই সময়টাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না।
কেএম/আরএ/