টিপু হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে তদবির!
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেসময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। টিপুকে হত্যা করতে রাজধানীর দুটি রেস্তোরাঁয় দুই দফায় বৈঠক করে সন্ত্রাসীরা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম বৈঠকে অংশ নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ও জাফর আহমেদ ওরফে মানিক। তারা জাহিদুলকে হত্যার নির্দেশ দেয়।
টিপু হত্যায় গ্রেপ্তার সুমন শিকদার ওরফে মুসার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদারকি কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ।
এদিকে পুলিশ বলছে, টিপু হত্যার মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আসামিদের জন্য তদবির করছে অনেকেই। কিন্তু সেই তদবির আমলে নিচ্ছে না পুলিশ। তবে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) মুঠোফোনে ঢাকাপ্রকাশ-কে ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ বলেন, এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আসামিদের তদবির আছে। কিন্তু আমরা তা আমলে নিচ্ছি না। মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্ত শেষে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার ২৫ জনের বাইরে আরও কিছু ব্যক্তি টিপু হত্যায় জড়িত। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তথ্য প্রমাণ পেলেই আমরা তাদের ধরে ফেলব।
একই কথা বলছেন টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফোন দিয়ে আমাকে বলা হচ্ছে, ৪ জনের নাম যাতে না আসে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে একে একে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন আসামিরা।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আমাদের হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে ছেলে-মেয়ে নিয়ে নিরাপত্তার হুমকিতে রয়েছি। এ অবস্থায় হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে সন্তানদের নিয়ে আমার দিন কাটছে।
পুলিশ বলছে, সম্প্রতি সুমন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দিতে এই হত্যায় জড়িত ১৬ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার নাম হত্যা মামলা থেকে বাদ দিতে বিভিন্ন মহল থেকে তদন্ত কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
টিপু হত্যাকাণ্ডের পর দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন সুমন। গত বছরের ৯ জুন ওমান থেকে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে পুলিশ। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পুলিশ বলছে, টিপু হত্যায় মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র্যাব। তাদের মধ্যে হত্যার পরিকল্পনাকারী সুমন, ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও নাসির উদ্দিন ওরফে মানিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, টিপু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (এক্সেল সোহেল)।
ডিবি ও আদালত সূত্র জানায়, সুমন তার জবানবন্দিতে নিজেকে রাজধানীর পল্লবী এলাকার ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার বলেও দাবি করেন। জবানবন্দিতে সুমন বলেন, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় ‘শুটার’ মাসুম কাছ থেকে জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করেন। ঘটনার সময় তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন শামীম।
সুমন জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারের ছোট ভাই টিটুকে ফোন দেন। তিনি তাকে বায়তুল মোকাররমের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘রুফটপ’ রেস্তোরাঁয় থাকতে বলেন। সেদিনই তিনি সেখানে যান। সেখানে আশরাফ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার ওরফে রানা, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা ওরফে সাগর, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল ওরফে আমিনুর, বাবুল তালকুদার, রিফাত, টিটু ও খাইরুলকে দেখতে পান। বৈঠকে ঠিকাদারি ও স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে কথা শুরু হয়। একপর্যায়ে সোহেল শাহরিয়ার রেগে গিয়ে বলেন, জাহিদুল টেন্ডারের মধ্যস্থতা করেন,কিন্তু তাদের কাছে এসবের সঠিক হিসাব দেন না।
জবানবন্দিতে সুমন বলেন, মারুফ ডিশের ব্যবসা করেন। তার লোকজন ডিশের লাইন দিতে শাহজাহানপুরে গিয়েছিলেন। তখন তাদের মারপিট করেন জাহিদুলের লোকজন। এ ঘটনায় মারুফ মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ জাহিদুলের লোকদের গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো জাহিদুল পুলিশের কাছে মারুফের বিরুদ্ধে বিচার দেন। তখন মারুফ রাগারাগি করেন। ‘রুফটপ’ রেস্তোরাঁর বৈঠকে সবাই জাহিদুলের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কেএম/এসজি