‘অ্যালান চেইনি’কে সম্মাননা দিলো এসিআইই
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সবুক বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেছেন, ‘আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমটি শ্রেণী অনুসারে শিক্ষার্থীদের নানা ধরণের চাহিদাগুলোর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এখানে ছাত্র, ছাত্রীরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাদের শ্রেণী পাঠকে একত্র করতে পারবে। এটি চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। সমাধানভিত্তিক পড়ালেখা। শ্রেণী পাঠকে অনুশীলনের মাধ্যমে শেখায় নিয়ে আসতে পারবে। ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিদ্যালয় এখন আর কেবল পড়ালেখার জায়গা নয়। এখন এক একটি সামাজিক কেন্দ্র। ছাত্র-শিক্ষকের সহযোগিতার ভিত্তিতেই এই শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হবে।’
ইউনেসকোর কান্ট্রি ডিরেক্টর ‘গেষ্ট অব অনার’ বিট্রিস কালখুদ বলেছেন, ‘আমরা চাই শিক্ষাবিদ ও যারা শিখছেন, তাদের সবার জন্য শিক্ষা সুবিধা সৃষ্টি করবে। আমাদের পড়ালেখা শান্তিপূর্ণ বিশ্বে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। শিক্ষা মানের দিক থেকে আরো উন্নত হবে। শিক্ষার মাধ্যমে জীবনভর দক্ষতাগুলো তৈরি হবে। ইউনেসকো রেডিওভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমও প্রদান করছে। ২০১৫ সাল থেকে আমরা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ইকুইলিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন ইন এডুকেশনের সঙ্গী। এজন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।’
ইউসেপ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক সচিব ড. মো. আবদুল করিম বলেছেন, ‘১৯৭০ সালের সাইক্লোনের পর এই দেশে ত্রাণ দিতে এসেছিলেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক অ্যালান চেইনি। এরপর থেকে তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো শুরু করেন। সারাজীবন কোনো টাকা-পয়সা না নিয়েই কাজ করে গিয়েছেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শ্রেণী পাঠ শেষের পর পড়ানোর সুবিধা প্রদান করে। এরপর তাকে ঢাকার সেগুন বাগিচায় এখনকার চেইনি টাওয়ারটির জায়গা বরাদ্দ দেন বঙ্গবন্ধু। মেয়ে ও প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্তদের পড়ালেখার তিনি অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন। তিনি চেয়েছেন কোয়ালিটি ইনক্লুসিভ এডুকেশন ফর অল। তার জীবনের লক্ষ্য হলো হেল্প টু লার্ন। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে ও সব ধরণের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার ভুবনে পৌঁছেছে ইউসেপ বাংলাদেশ। এখন আমরা সরকারকে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সাহায্য করছি। তবে আগের মতো আমাদের আর কোনো দাতা নেই। ফলে আমরা বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে আমাদের কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করি। মোবাইল কম্পানির সিম কার্ডও বানাই। বাংলালিংক এজন্য আমাদের সাহায্য করে। শিক্ষকদের অবস্থানও আমরা ট্র্যাক করতে ট্র্যাকার তৈরি করেছি। আমাদের সারা দেশে মোট ৩২টি বিদ্যালয় আছে। যেগুলোতে সাধারণ লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়া ছেলে, মেয়েরা বিনাবেতনে পোশাক ও বইখাতার খরচ নিয়ে আবার প্রথম থেকে ১০ম শ্রেণী পযন্ত পড়ালেখা করতে পারছে। এর বাদেও সরকার পাইলট প্রকল্প হিসেবে আমাদের মাধ্যমেই দেশে প্রথম ও একমাত্র জেএসসি পাইলট ভোকেশনাল এডুকেশন প্রজেক্ট শুরু করেছেন। আমরা শেখ রাসেল ডিজিটাল ইনোভেশন ল্যাবরেটরিগুলোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে চলেছি।’
অধ্যাপক ড. নিরাফাত আনাম মেমোরিয়াল ইকক্লুশন অ্যাওয়ার্ড (নামি) প্রদান করা হয়েছে তাদের ইউসেপ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা লিন্ডসে অ্যানাল চেইনিকে। এটি পঞ্চম সম্মাননা। এই উপলক্ষে মোট ২ লাখ ১০ হাজার টাকার একটি চেক প্রদান করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণীর মোট পাঁচজন ছাত্র, ছাত্রীর পাঁচ বছরের শিক্ষা ও জীবনভাতা প্রদান করা হলো বলে জানিয়েছেন এশিয়ান সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ এডুকেশন (এসিআইই)’র সদস্য সচিব, এশিয়ান জানাল ফর ইনক্লুসিভ এডুকেশনের সম্পাদক ও সিক্সথ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ইকুইলিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন ইন এডুকেশনের আহবায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট)’র বিশেষ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান। তিনি আরো জানিয়েছেন এই আন্তর্জাতিক সম্মেলেনের তিন দিনে মোট ১৭টি দেশের ৭৮টি গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে। অংশ নিয়েছেন সরকারী, বেসরকারী, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষক শিক্ষাবিদরা।
একীভূত শিক্ষার ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ভারতের পুনে ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের গ্রিন, আইইউবি (ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভাসিটি বাংলাদেশ), ইউনেসকোর ঢাকা অফিস, সিবিএম গ্লোবাল, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, রুম টু রিড, সিসিমপুরের সিসিম ওয়ার্কশপ সহ-আয়োজক হিসেবে অংশ নিয়েছে।
তাদের মধ্যে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের শিক্ষা প্রকল্পের প্রধান দীপা সাহা বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের পাঁচটি জেলায় মোট ৪৫টি স্থানে শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’
রুম টু রিডের দেশীয় প্রতিনিধি রাখী সরকার বলেছেন, ‘আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়া ও শেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। আমরা তাদের সাফল্যের স্বীকৃতি দেই।’ শেষ দিনের উপস্থাপক ছিলেন আইইআরের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমেরা আহসান রচনা।
সমাপনী দিনে এই আয়োজনের প্রাণ অধ্যাপক ড. তারিক আহসান বলেছেন, ‘মানুষের মূল্যবোধগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের শিক্ষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এই বোধগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। চলুন আমরা সবাই একটি উন্নত বিশ্বের জন্য শিক্ষার মাধ্যমে কাজ করি।’
সমাপনী দিনের বিশেষ অতিথি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ড. কুদরত-ই-খুদাকে শিক্ষানীতি তৈরির জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যমে একটি উন্নত জাতি, জীবনবোধ গড়ে তুলতে কাজ করেছেন তিনি। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পড়ালেখার ব্যবস্থা করার শিক্ষানীতিও তৈরি করেছিলেন। তবে আমাদের এখন শিক্ষা ও কাজের ভুবনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এই বিষয়ে শিক্ষকদের কাজ করতে হবে। সকলের সমান অংশগ্রহণ ও সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলার শিক্ষা কার্যক্রম সরকার পরিচালনা করছে। যে লোকটি লেখাপড়ার সুযোগ পান না, সেই চাষীকেও অক্ষরজ্ঞান প্রদান করার কাজ করে চলেছে আমাদের সরকার। ফলে তিনিও এখন প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারছেন। মোবাইল চালাতে পারছেন। বিকাশ ব্যবহার করছেন। আগে বোর্ড স্টান্ড, স্টার মার্কস ছিল। এখন আর নেই। কেননা গুটিকয়েক এমন ফলাফলধারী বানিয়ে লাভ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো আভিজাত্যপূর্ণ মানসিকতা লুকিয়ে আছে। এর বাইরে এসে জীবনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে অধ্যাপকদের কাজ করতে হবে। যে চিকিৎসক ফলাফলকেন্দ্রীক পড়ালেখা করেন, তিনি আর সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন না, দেবেন না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য আছে, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বৈষম্য আছে। সেজন্য আমরা সবাই কাজ করছি। অর্থ, বিত্তই জীবনের চাবিকাঠি-এই শিক্ষা দেওয়া, এই মানসিক বৈষম্য আছে। শিক্ষায় যে সবচেয়ে মেধাবী সে বিজ্ঞানে, যারা সবচেয়ে দুর্বল তারা ভোকেশনালে যাবে কেন? আমরা কেন জাতিগতভাবে পড়ালেখার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে পারছি না? ধর্মীয় শিক্ষায় নৈতিকতার চর্চা, আত্মার পরিশুদ্ধতার চর্চাকে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই তো আমরা জ্ঞাননির্ভর অথনৈতিক ব্যবস্থায় যাব। আমরা জাতীয় পরীক্ষা মূল্যায়ন কেন্দ্র তৈরি করছি। ধারাবাহিক, শ্রেণীকক্ষ মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করছি। আগামীর প্রজন্ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবসময় ভাবছেন। বিদ্যালয়গুলোকে এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে। শিক্ষকদের মান, প্রশিক্ষণ ও বেতনের ওপর আমরা জোর দিচ্ছি।’
এশিয়ান সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ এডুকেশনের আয়োজনে এই ষষ্ঠ একীভূত শিক্ষা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শুরু হয়েছে ১৯ মে। শেষ হয়েছে ২১ মে। প্রথম দিনের প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘সরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় এগিয়ে দিচ্ছে।’ এই দিনের বিশেষ অতিথি আইইআর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও আইইআর পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল হালিম। শেষ দিনের প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণি।