বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতির প্রতি অক্ষয় ভালোবাসা
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। যোগাযোগ বিষয়ে আধুনিক নিয়ম-কানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে এ ঐতিহাসিক ভাষণে।
প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এ কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। সম্প্রচারতত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। ১ হাজার ১০৭ সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোনো বাহুল্য নেই আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দুয়েকটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে।
ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ অত্যন্ত কার্যকর বক্তব্যের অবতরণিকা যা পুরো মূলভিত্তি তৈরি করেছে ও শ্রোতাকুলকে অভ্যুদিত বক্তব্যের আভাস দিচ্ছে।
পুরো বক্তব্যের আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মূলত পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা ও তার স্বাভাবিক অনুযাত্রায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্বাঞ্চলের পরিসমাপ্তির প্রজ্ঞপ্তি ও বিবরণী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও মূলসূত্র ৭ মার্চের এ ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ ভাষণ ছিল আমাদের সিংহনাদ বা যুদ্ধশ্লোগান। শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সকলের গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেত এ ভাষণ শ্রবণে। বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করেনি, মাত্র আঠার দিন পর তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। কারণ, এ ভাষণই ছিল কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না’- বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ প্রসঙ্গে প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদক কামাল লোহানী বলেছিলেন, ‘সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এই বলিষ্ঠতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি জাতিরাষ্ট্র-একইসঙ্গে মুক্তিদাতা হিসেবে মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন।’
জনযোগাযোগে যেসব ব্যবহার করার কথা তা অত্যন্ত সঠিকভাবে সুপ্রযুক্ত হয়েছে ভাষণে। বাংলাদেশের জন্মের প্রাক্কালে বাংলার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার সংলাপ ভাষণ। প্রাঞ্জল কথোপকথনের ভঙ্গিমায় অতি সহজ সাবলীল ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে রচিত এ ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার মূল দলিল। শ্রোতাকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে তিনি সংলাপের বাচনশৈলী অনুসরণ করেছিলেন অত্যন্ত সূচারুভাবে। ভাষণে বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সরাসরি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন পাঁচটি: কী অন্যায় করেছিলাম? কী পেলাম আমরা? কিসের আর.টি.সি.? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?
বক্তার সঙ্গে শ্রোতার মেলবন্ধন সৃষ্টিতে পরামর্শের সুপ্রয়োগ ঘটেছে এ ভাষণে। পুরো ভাষণে বর্তমানকালের যৌক্তিক ব্যবহার ভাষণে সজীবতা দিয়েছে। আবার কথোপকথনের ধারার স্বার্থে তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎকালের সুন্দর সংমিশ্রণও ঘটিয়েছেন এ ভাষণে।
ভাষণে যেসব অংশে বঙ্গবন্ধু আদেশ, নির্দেশ বা সতর্ক সংকেত দিচ্ছেন সেসব স্থানে বাক্যগুলো স্বাভাবিকভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। বহু গবেষণার পর যোগাযোগতাত্ত্বিকদের বাক্য সংক্ষিপ্ত করার বর্তমান নির্দেশিকা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যথাযথ প্রতিফলিত। ভাষণ থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’; ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’; ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি: আমি যা বলি তা মানতে হবে’; ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না; ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাষণের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্মোদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে শ্রোতাদের শুধু পরিচিতি করানোই নয়, বরং তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উদবুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। বঙ্গবন্ধু কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে সাধন করেছিলেন তার এ ভাষণের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর প্রোৎসাহমূলক বক্তব্য ‘তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সাড়ে সাতকোটি বাঙালি এ বক্তব্যকেই হুকুমনামারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাদেশ বলে সেদিন গ্রহণ করেছিলেন।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণের সময়ও তার মানবিক উদারতার কোনো হেরফের কখনো যে ঘটেনি তার পৃকৃষ্ট প্রমাণ ৭ মার্চের ভাষণ। রাষ্ট্রের জন্মমৃত্যুর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েও তিনি ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করেন ‘তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না।’ কঠিনের সঙ্গে কোমলের এমন সহাবস্থান উদার-হৃদয় বঙ্গবন্ধুর মাঝে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল।
যথাযথ তথ্য চয়নের ফলে ভাষণটি অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ হয়েছে, আর তীক্ষ যুক্তিবিন্যাসের কারণে শ্রোতাদের মাঝে তীব্র প্রণোদনা সঞ্চারে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-র্আত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর গুলি হচ্ছে। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ সহজ ভাষায় এ ধরনের জোরালো যুক্তিবাদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এক সহজাত বিশেষত্ব। বক্তব্যের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ভাষণের মাঝামাঝি এসে সূচনা বক্তব্যের সম্প্রসারণ বা পুনরাবৃত্তির কথা বলা হয় যোগাযোগ বিজ্ঞানে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আশ্চর্যজনকভাবে এ দিকটিও প্রতিভাসিত যখন তিনি ভাষণের মাঝামাঝি এসে বলেন, ‘তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’
সর্বজনীন বক্তব্যে ও জনযোগাযোগে কার্যকর ফল লাভের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্থাপন সর্বজনবিদিত একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে এসে যখন বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শালাহ’ তখন বোঝা যায় যে তিনি যোগাযোগবিদ্যার শিল্পকুশল প্রণালীতে পরম দক্ষতায় কীভাবে শ্রোতাদের বক্তব্যের সঙ্গে গেঁথে ফেলেছেন।
যেকোনো ভাষণের সংজ্ঞানির্ধারণী অংশ সাধারণত শেষেই উচ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে যোগাযোগবিদদের আধুনিক অভিমত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শেষবাক্য ‘এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অত্যন্ত দৃঢ়প্রত্যয়ে ব্যক্ত স্বাধীনতার কার্যত ঘোষণা যা ৭ মার্চের ভাষণের সংজ্ঞা হিসেবে স্বীকৃত। যে প্রক্রিয়ায় তিনি ভাষণ শেষ করেছেন তা যোগাযোগবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, যেখানে বলা হয় আমরা প্রায়ই ‘পরিশেষে বলছি’, ‘একটি কথা বলেই শেষ করছি’ বা ‘পরিশেষে এ কথাটি না বললেই নয়’ ইত্যাদি ভূমিকা করে বক্তব্য শেষ করি।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি এ প্রবেশ করেছেন যা আধুনিক তত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ এবং যা ছিল পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে অকল্পনীয়।
আমরা জানি যে, বলিষ্ঠ বক্তব্য সর্বদাই সংক্ষিপ্ত হয়। একাত্তরের ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তট-অতিক্রমী ভাষণ তেজস্বী ভাষণের এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একটি ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কী দারুণভাবে উৎসাহিত করেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কণ্ঠস্বরসংবলিত এ ভাষণের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও সময়োপযোগিতা বিশ্লেষণ গবেষকদের জন্য এক স্বর্ণখনি।
এ ভাষণ বাঙালিকে যেভাবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীক্ষিত করেছিল তা পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে নতুন এক আলেখ্য। সার্বজনিক বিশারদ, গবেষক ও যোগাযোগবিদদের জন্য এ ঐতিহাসিক ভাষণ একটি আবশ্যকি পাঠক্রম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। আমাদের বঙ্গবন্ধুর নিন্মোক্ত মূল্যবান উক্তি উল্লেখ করে আমি জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি।
‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েইে আমি ভাবি একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তত্বিকে র্অথবহ করে তোলে।’
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়