বঙ্গবন্ধু অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মূল কারিগর
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এই দিনটিকে বেছে নিয়েছে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তথা দেশের মেধাবী ছাত্ররা রাজপথে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। ভাষার জন্য তাদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বিশেষ করে ভাষা শহীদদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আজ অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এটি আমাদের জন্য গর্বের, অহংকারের ও আত্মমর্যাদার। মাতৃভাষার কল্যাণে আজকে সারা পৃথিবীতে যে কার্যক্রম পরিচালিত হয় তার বীজ রোপণ করেছিলাম আমরা। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় সেদিনটিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেই সময়ের তরুণ ছাত্র নেতা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সেদিন পাকিস্তান কারাগারে নিক্ষিপ্ত হোন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১১ই মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে গেলেন, তখনই তিনি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, এভাবে বাঙ্গালির মুক্তি সম্ভব নয়। তিনি বুঝেছিলেন বাঙ্গালির মুক্তির প্রথম সোপান হিসেবে রাষ্ট্রভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়োজন আছে। যখন জিন্নাহর মুখ থেকে ঘোষিত হলো, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ ছাত্রনেতা।
বঙ্গবন্ধু কত যৌক্তিকভাবে বললেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। তারপরও আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিচ্ছি না। কাজেই আমরা চাই, পাকিস্তানের পূর্ব অংশের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’। পশ্চিম অংশে যেকোনো একটি ভাষাকে তারা রাষ্ট্রভাষা করবে। বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কত যৌক্তিক একটি প্রস্তাব নিয়ে তিনি আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমরা পেলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা। যে মাইলফলকগুলো বঙ্গবন্ধু তৈরি করে গেছেন, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এ সবকিছুর সূচনা পর্ব যদি আমরা বলি, সেটিই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা, বাঙ্গালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের শেষ পর্যন্ত মুক্ত স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে।
এই বাংলা ভাষা আন্দোলনের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার নির্মাতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্মাতাও তিনি। সেকারণেই তিনি বাঙালি জাতির পিতা। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে যে দিবসটি উদযাপন করছি, এই দিনটিকে আমরা আরও বেশ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করব এজন্য যে, বাংলা ভাষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করব। সেটিই আমাদের অভিপ্রায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মকে আমাদের শুদ্ধ বাংলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের শুদ্ধ বাংলায় পড়ানো, শুদ্ধ বাংলায় লেখা এবং শুদ্ধ বাংলায় উচ্চারণ করা এ বিষয়গুলোতে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বাংলাভাষা এখন শুধুমাত্র ভৌগলিক অবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলা ভাষা এখন পশ্চিমবঙ্গসহ, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা পৃথিবীতেই বাংলা ভাষা সমাদৃত।
যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন, আজ ২১ ফেব্রুয়ারি মানে সারা পৃথিবীর জন্যই তাদের সে ভাষা একইসঙ্গে সেই জাতিকে, সেই জাতির ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের জীবন যাপন করার প্রয়োজন আছে। বাংলা ভাষাকে একটি পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমন্বয়ের প্রয়োজন আমাদের আছে। তাহলে আমরা যে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি, সেটি অনেকদূর এগিয়ে যাবে এবং অর্থপূর্ণ হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়