বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের ব্যর্থতা
গণহত্যা সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়, কোনো জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বা কোনো ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত যে হত্যাযজ্ঞ বা নির্বিচার আক্রমণ সেটিই গণহত্যা। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ এই সংজ্ঞা স্বীকৃত হয়েছে। অতএব বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে ১৯৭১ সালে যে ব্যাপক হত্যা, ধংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন ঘটে, সব অর্থেই তা ‘গণহত্যা’ বা ‘জেনোসাইড’।
বাংলাদেশের গণহত্যা বিংশ শতাব্দীর, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়াবহতম এক গণহত্যা, যা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিন ধরে পরিচালিত হয়েছে। এই সময়ে পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালিকে খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে এ সব বর্বরতায় সহযোগী হয়েছিল বাঙালি ও অবাঙালি মিলিয়ে গড়ে তোলা রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা। সেই বর্বরতার স্মৃতিচিহৃ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে, আছে পাঁচশতের ওপর বধ্যভূমি, অসংখ্য গণকবর ও গণনির্যাতন কেন্দ্র। সাম্প্রতিক এক জরিপে একমাত্র ২০টি জেলাতেই ৪০৪টি বধ্যভূমির খোঁজ পাওয়া গেছে।
সেদিনকার স্নাযুদ্ধের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাঙালি গণহত্যার বিষয়টি যতটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যক্রম তা হয়নি। কিন্তু ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং ব্যক্তি ও সংস্থার গবেষণায় এর ব্যাপকতা স্ববিস্তারে গ্রন্থিত আছে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বাঙালি গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তারপরেও সেদিনকার মহাসচিব ইউ থান্ট ৩ জুন ১৯৭১ সালে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য— The happenings in East Pakistan constitute one of the most tragic episodes in human history. Of course, it is for future historians to gather facts and make their own evaluations, but it has been a very terrible blot on a page of human history.
গণহত্যার শুরু
বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর এই বর্বরতা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির বাস্তবায়ন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল পশুশক্তির ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ন্যায্য অধিকার দমন করা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে দেশের সামরিক সরকার কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করার পথ বেছে নেয়নি, একই সঙ্গে তারা সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য, পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্রজনতাকে নিধন করার পরিকল্পনা করেছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই অতর্কিত সামরিক অভিযানের ফলে জীবন বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে ভারতের মাটিতে ১ কোটি মানুষের মর্মদন্ত শরণার্থী জীবনের সূচনা ঘটে।
২৫ মার্চের অভিযান শুরুর আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ দেশ থেকে প্রতিটি বিদেশি সাংবাদিককে জোর করে বের করে দেয়। স্থানীয় প্রচার মাধ্যমের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করে। এর পরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক লুকিয়ে থাকেন। তাদেরই একজন সাইমন ড্রিং। ৩১ মার্চ তিনি লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এ তার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন প্রকাশিত করেন।
প্রতিবেদনটি বাংলায় এ রকম— ‘২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে। সর্বত্র বোমা বারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা-অভিযানে বিধ্বস্ত হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনী নির্বিচারে ভারী আর আর গান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে। ইকবাল হলকে তারা প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সেখানে প্রথম ধাক্কাতেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়। একদিকে হলগুলোর দিকে উপর্যুপরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দু’দিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালা-দরজায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথেঘাটে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। জগন্নাথ হলেও বর্বরোচিত আক্রমণ চালানো হয়। কয়েক শত ছাত্র, যারা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিহত ও আহত হয়। সৈন্যরা মৃতদেহগুলোকে গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেয়। এরপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে।’
রিপোর্টের একটি অংশ এ রকম— ‘আল্লাহ ও পাকিস্তানের ঐক্যের নামে’ ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত, সন্ত্রস্থ নগরী।’
‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এর ভাষ্য মতে, ঢাকার মাটিতে একমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ১ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস ৪/১/৭১ তারিখে ৩৫,০০০ নিহত হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এই নির্বিচার গণহত্যার প্রথম বর্ণনা দেন এন্থনি মাসকারানহাস লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায়। ১৩ জুন ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত মাসকারানহাসের রিপোর্টটি পড়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবেকআপ্লুত হন। পত্রিকার সম্পাদক হেরাল্ড ইভান্সের ভাষায়— ‘That the article had shocked her so deeply it had set her “on a campaign of personal diplomacy in the European capitals and Moscow to prepare the ground for India’s armed intervention”.
বিশ্ব প্রতিক্রিয়া
কেবল দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলের হিসাবেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার জোড়ালো সমর্থন আছে National Geographic magazine, Encyclopedia Americana এবং Compton’s Encyclopedia তে। এদের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনী ও ১৯৩৫ সালের নানজিং বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ। এই গণহত্যা সম্পর্কে অন্যতম প্রধান পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘paint the green of East Pakistan red, অর্থাৎ বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দাও। তারা তা করেছিলও!
এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবতাবাদী বিশ্ব সরব হয়ে ওঠে। গণহত্যা বন্ধে জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবি শঙ্কর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। নতুন দিল্লি, প্যারিস ও লন্ডনে সরব হন মানবতাবাদীরা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অ্যাঁদরে মালরো বাংলাদেশের পক্ষে ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’ গঠনের ঘোষণা দেন।
আন্তর্জাতিক গবেষক রবার্ট পাইন তার Massacre, The Tragedy of Bangladesh বইতে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দেন এভাবে— ‘Kill three million of them and the rest will eat out of our hands’। ১৯৮১ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, ‘Among the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day.... This is the highest daily average in the history of genocide's.’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাজ্ঞকে selective genocide বা genocide হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ঢাকায় দায়িত্বরত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড, পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে জরুরি কূটনৈতিক বার্তা পাঠান। এ সব বার্তায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ আছে। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক R.J. Rummel লেখেন— These ‘willing executioners’ were fueled by an abiding anti-Bengali racism, especially against the Hindu minority. ‘Bengalis were often compared with monkeys and chicken …. And the soldiers were free to kill at will.
পাকিস্তানি অবস্থান
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে জেনারেল নিয়াজীসহ ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের বিচার করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তখনকার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিসহ এই যুদ্ধাপরাধীরা তাদের দেশে ফিরে গেছে। স্মরণযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪ লাখ বাঙালি পাকিস্তানের মাটিতে আটকে পড়ে, যাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টো পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে বাঙালিদের বিচার করার ঘোষণা দেন।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে গণহত্যার কথা আকারে ইঙ্গিতে স্বীকার করলেও হত্যাযজ্ঞের দায় কখনো স্বীকার করেনি পাকিস্তান। বরং এই গণহত্যার ঘটনাবলিকে দেশটি পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে পাকিস্তান ‘deeply regretted any crimes that may have been committed’ কথাগুলো বলে বিচারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে ১৯৭১-এর ঘটনার জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেন। ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এসে ১৯৭১-এর ‘বাড়াবাড়ি’ এর জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার চলাকালে নওয়াজ শরীফের সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে আসে এবং ইতিহাস পুরোপুরি অস্বীকার করে! অন্যদিকে ইমরান খানের সরকার তাদের সেনাবাহিনীর হাতে সংঘঠিত অপরাধের যৎসামান্য সমালোচনা করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, যদিও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যর্থতার জন্য সরাসরি দায়ী করেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজও পর্যন্ত কোনো ক্ষমা প্রার্থনা করেনি পাকিস্তান। এমনকি বাংলাদেশ যে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করে আসছে, সে লক্ষ্যেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছাড়িয়ে নিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতিটি প্রচার করে, তা ছিল এ রকম— ‘Pakistan expresses its readiness to constitute a judicial tribunal of such character and composition as will inspire international confidence to try the persons charged with offenses.’
কিন্তু পাকিস্তান সে কাজটি আজ অবধি করেনি। শুধু তাই নয় তারা নতুন করে গণহত্যা অস্বীকারের অপপ্রচারে নামে। সরকারি ও বেসরকারি পুস্তক ও প্রচারপত্রে স্বীকৃত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে চলে তারা। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণ নির্ণয় করতে ১৯৭২ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করা হয় তার রিপোর্টটিকেও পাকিস্তান ২৮ বছর ধরে চেপে রাখে। ২০০০ সালে গণমাধ্যমে তার কিছু অংশ প্রকাশ হলে দেখা যায়, কমিশনে সাক্ষী দিতে গিয়ে সিনিয়র পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা প্রায় সবাই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছে। একজন পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তার জবানবন্দি এ রকম— ‘…… we were told to kill the Hindus and Kafirs .. One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the Kafirs in that area. We found all the village women reciting from the Holy Quran, and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time.’
ইত্যাদি অপরাধ বিবেচনা করে হামুদুর রহমান কমিশন সংশ্লিষ্ট সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের সুপারিশ করে। কিন্তু সে বিচার আজও হয়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাগ্রহণ করেনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে হয় তারা বিকৃত করেছে, নয় আড়াল করেছে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে মনগড়া ইতিহাস যোগ করে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসশূন্য করেছে। কিন্তু এতে ঐতিহাসিক সত্যের কিছু যায় আসে না। কারণ সেই বেদনাবিধুর অধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করার কোটি মানুষ এখনো আছেন, আছে হাজারো, লাখো স্মৃতিচিহ্ন, আছে অগণিত গণকবর, আছে দেশি-বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শী, সমীক্ষা ও গবেষণা— যা যুগ-যুগান্তর ধরে সত্যকে তুলে ধরবে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতির প্রশ্নে জাতিসংঘের দায়বদ্ধতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জাতিসংঘ এরই মধ্যে আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন, বসনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসে এবং যে দ্রুততায় বাংলাদেশের মাটিতে মানুষ হত্যা করা হয়েছে— তা বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য নজির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ৬০০০ মানুষ খুন করা হয়েছে মাত্র ২৬০ দিনে। কম্বোডিয়ার এই হার ছিল ১২০০। একমাত্র চুকনগরেই ২০ মে ১৯৭১ সালে একদিনে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শত শত শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে।
কিন্তু ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি থাকে, যা দিয়ে সে নিজেই তার সত্যকে রক্ষা করে। বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে গণহত্যা বিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট’ এবং ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান দুই সদস্য মিলে সম্প্রতি একটি বিলও পেশ করা হয়েছে। ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দিন যত যাচ্ছে ততই ইতিহাসের সত্য অবমুক্ত হচ্ছে। অতএব জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষায় বিশ্ব সংস্থাকে কালবিলম্ব না করে বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।
বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি কোনো প্রতিশোধ পরায়ণ আচরণ নয়, বরং মানব সভ্যতা সুরক্ষায় এবং এ ধরনের অপরাধের পূনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ভূমিকা। অন্যথায় এই ভয়ংকর অপরাধ বারবার ঘটবে। যেমনি অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর ঘটেছে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক
আরএ/