জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি জনগণ ও অর্থনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
আমি মনে করি, তেলের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি ছিল না। সরকার যে যুক্তিতে এটি করেছে তার কোনো ভিত্তি নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে তাই এখানেও দাম বেড়েছে এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। এটির যুক্তি এজন্য নেই যে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাচ্ছে। যেটি ১২০/১৩০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল, সেটি কমতে কমতে ৯০ ডলার পর্যন্ত চলে এসেছে। এটি আরও কমবে সামনে, সেরকম লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। সুতরাং তেলের দাম বিশ্ব বাজারে বেশি এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, সরকার বলছে কয়েক মাসে লোকসান হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। গরমিল থাকলেও আমরা যদি এটিই মনে করি, সরকারের ক্ষতি হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। তবে এর আগে কয়েক বছরে সরকারের লাভ হয়েছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সেটির কারণ হচ্ছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল, কিন্তু সরকার এখানে তেলের দাম কমায়নি। যেকারণে বাংলাদেশের মানুষকে অনেক বেশি দামে তেল কিনতে হয়েছে। তার মানে বাংলাদেশের মানুষের পকেটের টাকা দিয়ে সরকার মুনাফা করেছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং লোকসান বাদ দিলেও তাদের হাতে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা থাকে। সে হিসেবে আমাদের টাকা নেই, আমাদের টাকা খালি হয়ে গেছে, আমাদের কোনো উপায় নেই। এই কথাগুলি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুনাফার সঙ্গে যদি বিষয়গুলো এডজাস্ট করা যেত, তাহলে সরকার দাম না বাড়িয়ে বরং দাম কমানোর কথা চিন্তা করতে পারত।
তৃতীয়ত, তেলের উপর সরকার অনেক শুল্ক পায়। সেটি অনেক দেশে শুল্ক কম রেখে তেলের দাম কম রাখা হয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেটি কিন্তু বাদ দেওয়া হয়নি। সরকার এখন পর্যন্ত সেটি আদায় করে যাচ্ছে।
চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগেই বলছেন যে, অকটেন এবং পেট্রল দেশে গ্যাস উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বাই প্রডাক্ট হিসেবে আসে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটি আমাদের দেশে যা আছে তা চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত। চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত যদি থাকে, তাহলে বিশ্ববাজারে দামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ এটি খুব সহজেই দাম কমানো সম্ভব ছিল। যেহেতু এটি বাই প্রডাক্ট হিসেবে হয়, এটির কোনো উৎপাদন ব্যয় ছিল না। সুতরাং সব জায়গায় চিন্তা করতে পারত দাম কমানোর।
কাজেই যে চারটি পয়েন্ট আলোচনা করা হল, সেটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারের কোনো যুক্তিই আসলে ধোপে টিকে না। আরেকটি বিষয় যেটি তারা বলতে চায়, ভারতে দাম বেশি সুতরাং তেল পাচার হয়ে যাবে। পাচার ঠেকানোর জন্য তাদের নানারকম ব্যবস্থা আছে। বাহিনী আছে। কাজেই পাচার হয়ে যাচ্ছে মানে তাহলে সরকারের কাজটি কি? সরকারতো আছেই যেন পাচার না হয় সেটি ঠেকানোর জন্য। শুধু তেলের দাম বললে হবে না। মজুরি বলতে হবে। অন্যান্য জিনিসের দাম বলতে হবে। এটির কোনো যুক্তি হয় না।
সরকার সম্পূর্ণ নির্মমভাবে, সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে তেলের দাম বাড়াল, জ্বালানি তেলের দাম শতকরা ৫০% বাড়ানো হল, এর প্রভাব সবকিছুতে পড়বে। যেমন— বাসা ভাড়া বাড়বে, পরিবহন ভাড়া বাড়বে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ অর্থনীতির গতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের যে গতিশীলতা সেটিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই যেকোনোভাবেই হোক তহবিল বাড়ানোর দিকে সরকারের নজর। কারণ সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে, টাকা পাচার হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিভিন্নক্ষেত্রে সরকারের তহবিলের উপরে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সেই চাপটি কমানোর জন্য মুদ্রাপাচার বন্ধ করতে পারত অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করতে পারত। সরকার জনগণের পক্ষ থেকে আরও টাকা নেওয়ার চেষ্টা করছে, আইএমএফের কাছে থেকে লোন নিচ্ছে এবং যে লোনের শর্ত হিসেবে আবার জনগণের উপর নতুন নতুন আক্রমণ করা হচ্ছে। কাজেই সবকিছু দেখে এটি বলা বোধ হয় ভুল হবে না যে, এটি জনগণের বিরুদ্ধে এবং অর্থনীতির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
আরএ/