গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ এ যা থাকছে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সম্পাদিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি অবলম্বনে সংকলিত গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ এর দশম খণ্ড এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইটির সম্পাদনাও করেছেন তারা। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরই) প্রকাশনায় বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশের সেতুবন্ধ এ গ্রাফিক নভেলের প্রকাশক বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।
শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমি চত্বরে বইমেলায় গ্রাফিক নভেলটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন সাহিত্যিক আনিসুল হক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ ‘মুজিব’ গ্রাফিক নভেল সিরিজের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলো আরও ৯টি পর্ব। এসময় উপস্থিত ছিলেন, সিআরআইয়ের তন্ময় আহমেদ, শিল্পী শিবু কুমার শীল।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম কাজ ছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এ মহানায়ককে তুলে ধরা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তারা জানতো না বঙ্গবন্ধু কে এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য কী করেছিলেন। এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে! পৃথিবীর কোথাও ইতিহাসের মহানায়কদের নিয়ে এতো বড় অপরাধ ঘটেনি।
নতুন করে বঙ্গবন্ধুকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় সিআরআই-এর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান এই শিক্ষাবিদ।
সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু কীভাবে পরিশ্রম করলেন, কীভাবে পাকিস্তান থেকে ভাষা আন্দোলন হলো, ভাষা আন্দোলন থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হলো এগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারে রোজনামচা, আমার দেখা নয়া চীন গ্রন্থগুলো প্রতিটি বাঙালির অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু শিশুদের জন্য কী হবে? এই চিন্তা মাথায় রেখে সিআরআই, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। শুধু তাই নয়, এই কাজটি মাধ্যমে তারা জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন বলেন আমি মনে করি।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ছোট্ট মুজিবকে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। আর তারপর ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট মুজিবকে জাতির মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠতে দেখা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছুঁয়ে যাওয়া এমনি এক রিয়েল লাইফ হিরোর গল্পই গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’।
‘মুজিব’ এমন এক নাম যার বাস্তবতা কল্পনার জগতকেও হার মানাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য গর্ব করার মত বিষয় রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় বীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হতে পারত অসংখ্য গ্রাফিক নভেল। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়গুলোতে উল্টো এদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনার দিকে। আর এ ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি বার যে নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নামটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেতনাকে আরও কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারা যায় সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) প্রকাশিত গ্রাফিক নভেল 'মুজিব'-এর মাধ্যমে। শৈশব থেকে বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা। নিজ দেশ ও জাতির প্রতি তার দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা ও নেতৃত্ব ফুটে উঠেছে এই কমিক বইটির প্রতিটি পাতায়।
যা থাকছে গ্রাফিক নভেলে:
দশটি সিরিজের গ্রাফিক নভেল 'মুজিব'র প্রতিটি খণ্ডে তার জীবনের আকর্ষণীয় কিছু ঘটনা রয়েছে। প্রথম পর্বে স্কুলের শিশু ছাত্র মুজিবকে দৃষ্টিশক্তির সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করার পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গেলে কিভাবে তাকে আবার ফেরত আনা হয় এবং এরপর শৈশব ঘরে কিভাবে কাটে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে তার শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়ার ঘটনা। যেখানে তিনি ফুটবলের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। এই পর্বে মুজিব ও তার বাবার একটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ম্যাচে শেষ পর্যন্ত মুজিবের দল জয় পায়, নাকি তার বাবার দল?
তৃতীয় পর্বে দেখানো হয় দুর্ভিক্ষের চিত্র। যেখানে একজন গ্রামের যুবক ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। সংগঠক হিসেবে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে সব ধরণের ভূমিকা পালন করেন। এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করে মুজিব কী পারবে তার গ্রামের মানুষকে রক্ষা করতে?
চতুর্থ পর্বে অল্প টাকা নিয়ে মুজিবকে দেখা যায় দিল্লি যাত্রা করতে। সেখানে গিয়ে হঠাৎ বিপদে পড়লেন তিনি। কিভাবে সেই বিপদ কাটিয়ে উঠবেন মুজিব?
দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তার দৃঢ় সংকল্প বর্ণিত হয়েছে পঞ্চম পর্বে। যেখানে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মুসলিম লীগ নেতার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিলো। কী করেছিলেন তখন মুজিব?
ষষ্ঠ পর্বে তার আজীবন রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের গল্প আঁকা হয়েছে। এইভাবে গল্পটি তার স্বপ্নময় যৌবন থেকে রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ে চলে গিয়েছিল যা পরবর্তীতে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। মুজিবের রাজনীতিতে প্রবেশের রোমাঞ্চকর বর্ণনা রয়েছে এই পর্বে।
উপমহাদেশকে বিচ্ছিন্নকারী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে চিত্রিত করা হয়েছে সপ্তম পর্বে। যেখানে রাস্তাঘাট লাশে ছেয়ে গেছে। কারফিউর মধ্যেও মুজিব তার জনগণকে সাহায্য করতে বেরিয়েছিলেন। একটি মিলিটারি জীপ তার কাছে এলে সে অন্য লাশের পাশে মরার মতো ভান ধরে শুয়ে পড়েন। ভারতীয় অহিংস নেতা মহাত্মা গান্ধীকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় সেই দাঙ্গা। মুজিব সেই দাঙ্গার ছবি লুকিয়ে কিভাবে মহাত্মা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দেন, জানা যাবে এই পর্বে।
অষ্টম পর্বে তুলে ধরা হয়, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা। যেখানে মুজিব কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করেন। একটি ঘটনায়, সাইকেল আরোহী মুজিবকে তাড়া করছিলো পুলিশ জিপ। কিন্তু কেনো তাড়া করছে, তাকে কী পুলিশ ধরে ফেলেছে, কি হয়েছিলো তারপর? এমন সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই পর্বে।
দেশভাগ পরবর্তী টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণ নেতা মুজিবের শাসক গোষ্ঠীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দলকে সংগঠিত করার রোমাঞ্চকর সব অভিযানের গল্প রয়েছে গ্রাফিক নভেলটির নবম খণ্ড ‘মিশন পাঞ্জাব’ এ। এই পর্বে মুজিব বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকার জানত আমাকে পারমিটের কারণে তিন দিনের ভেতরেই দেশে ফিরতে হবে। তাই বর্ডার পুলিশ কাস্টমস আমাকে গ্রেপ্তার করতে আসবে সে কথা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিলো? মুজিবকে কী গ্রেপ্তার করতে পেরেছিলো তারা? জানা যাবে এই পর্বে।
‘মুক্তির পথে’ মুজিব গ্রাফিক নভেলের সর্বশেষ পর্ব। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দি জীবনের কথা বর্ণনা হয়েছে। জাতির মুক্তি আন্দোলনে ১৮ মাস বন্দি। আর কতদিন বন্দি থাকতে হবে মুজিবকে? পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মিথ্যা অপবাদ, জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার গল্প জানা যাবে সর্বশেষ এই পর্বে।
সিআরআই-এর জনপ্রিয় প্রকাশনা গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় প্রতিষ্ঠানটির ৭৩৫-৭৩৬ নম্বর স্টলে। এ ছাড়াও বইটি মিলবে ‘বাতিঘর’ প্রকাশনীর স্টলে।
সিআরআই-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২৩৫ ও ২৩৬ নম্বর স্টলে একসঙ্গে ১০টি খণ্ডের মূল্য রাখা হয়েছে ৯০০ টাকা। আলাদা করে প্রতিটি খণ্ড ১০০ টাকা। কিন্তু সব ছাত্রদের জন্য (স্টুডেন্ট আইডি সরবরাহ করতে হবে) ১০টি খণ্ডের দাম রাখা হয়েছে ৭৫০ টাকা।
এসএম/